গণবার্তা রিপোর্টার: সংকটের কারণে বিভিন্ন খাতের ভর্তুকির অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। এতে করে ব্যাংকের দেনা শোধ করতে পারছে না গ্রাহকরা। তাই এ সংকট সমাধানে ভর্তুকির বিপরীতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অনুকূলে বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রথমে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালি ব্যাংক ও বেসরকারি খাতের আইএফআইসি ব্যাংকের অনুকূলে সার কেনার ভর্তুকির বিপরীতে বন্ড ইস্যু করা হবে। এ বিষয়ে আজ সার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হওয়ার কথা রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ভর্তুকির বিপরীতে বন্ড ইস্যুর বিষয়টি নিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরেই কাজ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষ, ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েক দফায় বৈঠক হয়েছে। গতকালও এ-সংক্রান্ত একটি সভা হয়। তাতে জানানো হয়, বন্ড ইস্যুর বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সোনালী ও আইএফআইসি ব্যাংকের অনুকূলে বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে এ কার্যক্রম শুরু করবে অর্থ মন্ত্রণালয়।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে সারের ভর্তুকির বিপরীতে সোনালী ব্যাংকের অনুকূলে ৪ হাজার কোটি টাকা এবং আইএফআইসি ব্যাংকের অনুকূলে ৪৪৯ কোটি টাকার বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করা হবে। বন্ডের মেয়াদ হবে আট বছর। এক্ষেত্রে রেপো হার অনুসারে বন্ডের সুদের হার নির্ধারিত হবে। ব্যাংকগুলো বিশেষ এ বন্ডকে এসএলআর (বিধিবদ্ধ নগদ জমা) হিসেবেও দেখাতে পারবে। আজ সকাল সাড়ে ৯টায় সার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান, দুই ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এ বিষয়ে এমওইউ স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা রয়েছে। যদি কোনো কারণে তা সম্ভব না হয় তাহলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরদিন অর্থাৎ ৮ জানুয়ারি এটি স্বাক্ষরিত হবে বলে জানা গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে সার ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি বাবদ ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি বকেয়া। এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে সারে ১০ হাজার কোটি ও বিদ্যুতে ১৫ হাজার কোটি মিলিয়ে ২৫ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকির বিপরীতে বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করতে চায় সরকার। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সংখ্যা ৪০টি। বন্ডের মেয়াদ বিভিন্ন সময়ের জন্য নির্ধারণ করা হবে যাতে করে কোনো একক অর্থবছরে সরকারের ওপর একসঙ্গে খুব বেশি চাপ তৈরি না হয়। বন্ড ইস্যুর ফলে যদিও সরকারের ঋণ ও দায় আরো বাড়বে। তবে অর্থ সংকটের এ মুহূর্তে আর কোনো বিকল্পও নেই।
এর আগেও সরকারের এ ধরনের বন্ড ইস্যুর নজির রয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের দায়ের বিপরীতে এক সময় ব্যাংকের অনুকূলে বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করা হয়েছিল। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের রাজস্ব আহরণ যদি কাঙ্ক্ষিত হারে না বাড়ে এবং ব্যাংক খাতের অনাদায়ী ঋণ পরিস্থিতি ও সরকারের ব্যয় দক্ষতার উন্নতি না হয়, তখন এ ধরনের পদক্ষেপ সরকারকে আরো সমস্যায় ফেলবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব আয় করে সেটি দিয়ে তার ব্যয় মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ বাড়বে। অভ্যন্তরীণ দায়-দেনা পরিস্থিতি এমনিতেই নাজুক, সেটি আরো দুর্বল হবে। নতুন করে এ বন্ড ইস্যুর ফলে আগামী দিনে সরকারের যে ব্যয় হবে সেক্ষেত্রে সুদজনিত ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। এতে রাজস্বের অর্থ দিয়ে উন্নয়ন ব্যয় করার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়বে।’
অনাদায়ী ঋণ ও সুদহার বাজারভিত্তিক না করার কারণে ব্যাংক খাত এরই মধ্যে তারল্য সংকটের মধ্যে রয়েছে জানিয়ে এ অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, ‘অনেক ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় কম সঞ্চিতি রেখেছে। এ অবস্থায় নগদ অর্থের পরিবর্তে ব্যাংককে বন্ড দেয়ার কারণে নতুন করে বিনিয়োগের জন্য তারল্য থেকে বঞ্চিত হলো ব্যাংক। তাছাড়া রেপো হারের তুলনায় ঋণের সুদহার বেশি। ফলে ব্যাংক এক্ষেত্রে বাড়তি সুদ পাওয়া থেকেও বঞ্চিত হলো। সরকারের ঋণ যেভাবে পুঞ্জীভূত হচ্ছে, সেটি শোধ করার ক্ষেত্রে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা কী সেটি আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। যদি রাজস্ব আহরণে সংস্কার না হয়, অনাদায়ী ঋণ আদায় না বাড়ে এবং সরকারের ব্যয়ে দক্ষতা না থাকে তাহলে কিন্তু ভর্তুকির বিপরীতে বন্ড ইস্যুর যে সমাধান সেটি দুষ্টচক্রের মধ্যে ফেলে দেবে।’
২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ৪২ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা, জ্বালানি খাতে ৬ হাজার ২৩২ কোটি টাকা, কৃষি খাতে ২৬ হাজার ৫৫ কোটি টাকা ও সারে ২৫ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। আর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ ১ লাখ ১০ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
Posted ৮:০২ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৪ জানুয়ারি ২০২৪
দৈনিক গণবার্তা | Gano Barta