আজ, বৃহস্পতিবার


২৭শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দুদকের তদন্তে তমা ও ম্যাক্স গ্রুপের হরিলুটের গল্প

রবিবার, ২২ জুন ২০২৫
দুদকের তদন্তে তমা ও ম্যাক্স গ্রুপের হরিলুটের গল্প
সংবাদটি শেয়ার করুন....

স্টাফ রিপোর্টার: দেশের আলোচিত দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশ রেলওয়েসহ বিভিন্ন দপ্তরের হাজার হাজার কোটি টাকার টেন্ডার একচেটিয়া দখলে নিয়েছে প্রতিষ্ঠান দুটি। লুটের টাকার বড় অংশ ঠিকাদারি কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আমদানির নামে ভুয়া এলসি খুলে বিদেশে পাচার করেছেন ওই দুই কোম্পানির পরিচালকরা।কাজ পাওয়ার জন্য রেল ভবনের উচ্চ পদে প্রতিষ্ঠান দুটির নিয়ন্ত্রণে গড়ে উঠে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের সদস্যরা রেলের সব মেগা প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে গত ১৬ বছরে রেলের বিভিন্ন প্রকল্পের অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকার কাজ করেছে প্রতিষ্ঠান দুটি। এর থেকে তারা লোপাট করেছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। কাজ পাওয়ার পর দফায় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ও খরচ বাড়িয়ে লোপাট করেছে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা।ছাত্র জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে যান আওয়ামী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বৈরশাসকের পতনের পর দেশের বিভিন্ন প্রকল্পে ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র ফুটে উঠছে। সময়ের সাথে বেরিয়ে আসছে হরিলুটের ঘটনা। এই ধারাতেই সামনে আসে দেশের আলোচিত এই দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম।দুই কোম্পানির সীমাহীন দুর্নীতির তথ্যের ভিত্তিতে একাধিক অনুসন্ধানে এসব অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানে অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ, তার স্ত্রী ও গ্রুপের পরিচালক কানিজ ফাতেমা, তমা গ্রুপের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান ভূঁইয়া, তার মেয়ে ও গ্রুপের পরিচালক রাসনাত তারিন রহমান, ছেলে ও গ্রুপের আরেক পরিচালক মুকিতুর রহমান। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৮ এপ্রিল তাদের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত

দুদকের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) আকতারুল ইসলাম জানান, তমা ও ম্যাক্স গ্রুপের দুর্নীতিসংক্রান্ত নানাবিধ অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা দুদকের আইন ও বিধি অনুযায়ী অনুসন্ধান শেষে কমিশনে প্রতিবেদন পেশ করে থাকেন। প্রতিবেদনে মামলা করার সুপারিশ থাকলে এবং কমিশন সেটি অনুমোদন করলে পরবর্তী আইনগত প্রক্রিয়া শুরু হবে।দুদকের কাছে তথ্য আছে, যে কয়টি ব্যাংকের বিরুদ্ধে ঋণ কেলেঙ্কারির ভয়াবহ তথ্য রয়েছে, এর মধ্যে নতুন একটি ব্যাংক অন্যতম। এই ব্যাংকের পরিচালক পদেও আছেন তমা ও ম্যাক্স গ্রুপের কর্ণধাররা। ব্যাংকের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তাদের প্রভাব খাটিয়ে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন।জানা যায়, রাজবাড়ী-টুঙ্গিপাড়া রেলপথ প্রকল্প, পাবনার ঈশ্বরদী-ঢালারচর রেলপথ, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ, আখাউড়া-লাকসাম রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের মেয়াদ ও খরচ দফায় দফায় বাড়িয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা লোপাটের অভিযোগে তমা ও ম্যাক্স গ্রুপের পরিচালকদের বিরুদ্ধে ২০১৮ সাল থেকেই দুদকে অভিযোগ জমা হয়। কোনো কোনো অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রভাবে ফাইলবন্দি পড়ে থাকে। গত বছর সরকার পরিবর্তনের পর নতুন করে আরও অভিযোগ আসে। সেই সঙ্গে ফাইল অনুসন্ধানের কার্যক্রম নতুন করে শুরু হয়।দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণে কয়েকটি দেশি-বিদেশি কোম্পানি দরপত্র ক্রয় করে। যেসব প্রতিষ্ঠান দরপত্র ক্রয় করে, তাদের সবাইকে নিয়ে তমা ও ম্যাক্স সিন্ডিকেট গঠন করে। দরপত্র কেনা সব দরদাতা প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেটে শামিল হয়। একমাত্র চায়না লিমিটেড সম্মত না হয়ে আলাদাভাবে টেন্ডার জমা দিতে যায়। পরে চায়নিজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয়। এরপর রেল ভবনের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় তাদের উদ্ধার করা হয় এবং তারা টেন্ডার জমা দেয়। এই অনুসন্ধান প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। মামলা হয়নি তমা ও ম্যাক্স গ্রুপের বিরুদ্ধে। এমনকি অনুসন্ধান নিষ্পত্তিও করা হয়নি।

এছাড়া, আখাউড়া-লাকসাম ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে তমা ও ম্যাক্স গ্রুপের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। দেড় বছর অনুসন্ধান করে বিষয়টি ফাইলবন্দি হয়। এর পর সেই ফাইল গত মার্চ মাসে সচল হয় এবং পুনরায় অনুসন্ধানের জন্য দুদকের পরিচালক মো. আবুল হাসনাতের নেতৃত্বে চার সদস্যের বিশেষ টিম গঠন করা হয়। টিমের অপর সদস্যরা হলেন সহকারী পরিচালক আশিকুর রহমান, আল আমিন ও উপসহকারী পরিচালক সাবিকুন নাহার। টিমের সদস্যরা ইতেমধ্যে প্রকল্পসংক্রান্ত নথিপত্র সংগ্রহ করেছেন। নথিপত্রের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।যৌথভাবে এই প্রকল্পের কাজ পায় ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও তমা কনস্ট্রাকশন। কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া ২০১০ সালে নেওয়া এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ১০১ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ৫ বছর পর ২০১৮ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। ওই সময়ের মধ্যে তিনবার সময় বাড়ানোর পাশাপাশি নির্মাণ ব্যয় বাড়ানো হয় ৯৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১ হাজার ১০১ কোটি টাকার প্রকল্প গিয়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৩৫ কোটি টাকায়। এ প্রকল্পে অন্তত ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০১০ সালে পাবনার ঈশ্বরদী থেকে ঢালারচর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ পায় মাক্স গ্রুপ। ৫ বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও সাড়ে তিন বছর সময় বাড়িয়ে ২০১৮ সালে শেষ হয়। শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯৮৩ কোটি টাকা। ৩ দফায় ব্যয় বাড়ানো হয় ১ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা। প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পে ট্রেন চলে মাত্র একটি। অথচ এই রুটে ২০ থেকে ২৮টি ট্রেন চলার কথা ছিল।বিগত সরকারের সময়ে সবচেয়ে আলোচিত চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ। এ প্রকল্পেই বেশি অর্থ লোপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০১৬ সালে এই প্রকল্পে ১০১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা। সেই প্রকল্পে সব মিলিয়ে ব্যয় করা হয় ১৮ হাজার কোটি টাকা। তমা ও ম্যাক্স গ্রুপ সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্ধারিত সময়ে মূল কাজ শেষ করেনি। ধীরগতিতে কাজ করে তারা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি খরচও বাড়িয়ে নিয়েছে। ফলে সরকারি কোষাগারের শত শত কোটি টাকা গচ্চা গেছে।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৬:৫৩ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২২ জুন ২০২৫

দৈনিক গণবার্তা |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদকঃ শাহিন হোসেন

সহকারী সম্পাদকঃ মোঃ শাহ পরান হাওলাদার

বিপিএল ভবন (৩য় তলা ) ৮৯, আরামবাগ, মতিঝিল, ঢাকা ।

মোবাইল : ০১৭১৫১১২৯৫৬ ।

ফোন: ০২-২২৪৪০০১৭৪ ।

ই-মেইল: ganobartabd@gmail.com