আজ, শনিবার


২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দক্ষিণাঞ্চলের গতিপথ পরিবর্তন করেছে ইলিশ

মঙ্গলবার, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
দক্ষিণাঞ্চলের গতিপথ পরিবর্তন করেছে ইলিশ
সংবাদটি শেয়ার করুন....

নিজস্ব প্রতিনিধি: জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি নদ-নদীর নাব্যতা হারানো এবং শিল্প ও মনুষ্য বর্জ্যের কারণে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চল ও সংলগ্ন উপকূলভাগে ইলিশের বিচরণ ক্রমাগত পূর্ব-দক্ষিণ উপকূলে সরে যাচ্ছে। মৎস্যজীবীদের দাবি, আহরণ নিষিদ্ধকালীন বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ সীমার অভ্যন্তরে ভারতীয় জেলেদের অবাধ মৎস্য আহরণ মৎস্য সম্পদের ওপর আরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

গত কয়েক বছরে বরিশালের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলভাগে যেখানে ৬৮ থেকে ৭০ ভাগ ইলিশ আহরণ হতো, সেখানে গত কয়েক মাসে তা প্রায় অর্ধেকের মত হ্রাস পেয়েছে। একইসাথে বিগত গ্রীষ্ম মৌসুমে অতিরিক্ত তাপ প্রবাহ ও মূল বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির ব্যাপক ঘাটতির সাথে শীত মৌসুমে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হ্রাস পাওয়ার কারণেও ইলিশের বিচরণস্থল পরিবর্তনসহ জেলেরা নদ-নদী ও সাগর উপকূলে নামতে না পারায় ইলিশ আহরণ অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। মৎস্যজীবীরা আরও জানিয়েছেন, খুব সহসাই ইলিশের অবাধ ও সুস্থ বিচরণসহ প্রজনন ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটাতে না পারলে আগামীতে উৎপাদনেও বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, গত বছরের ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিনের মূল প্রজনন মৌসুমের আহরণ নিষেধাজ্ঞাকালীন দেশের ইলিশ প্রজন্মে আরও অন্তত ৪১ হাজার কোটি জাটকা যুক্ত হয়েছে। যা পূর্ববর্তী বছরে ছিল ৪০ হাজার ২৭৬ কোটি। মূল প্রজননকালীন দক্ষিণাঞ্চলের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় প্রজনন এলাকায় ৫২.০৪ ভাগ মা ইলিশ ডিম ছেড়েছে। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দশমিক ৫ ভাগ বেশি এবং আরও অন্তত ৩৫ ভাগ মা ইলিশ ডিম ছাড়ার অবস্থায় ছিল।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, ইলিশ উৎপাদনের ক্রমবর্ধনশীল ধারায় এখনো খুব বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব না পড়লেও ভবিষ্যতে বিরূপ পরিবেশ ও বিবিধ প্রাকৃতিক সমস্যা নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। তাদের মতে, মনুষ্যসৃষ্ট নানা কর্মকাণ্ডের সাথে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তনে এবার ইলিশের বিচরণ স্থলে বিরূপ প্রভাবে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলসহ সংলগ্ন উপকূলভাগে এবার ইলিশের বিচরণ কম থাকায় আহরণ কিছুটা কম লক্ষণীয়। ফলে বাজারে ইলিশ সরবরাহ ঘাটতির সাথে মূল্যও আকাশচুম্বী।

সূত্রমতে, গত ১ নভেম্বর থেকে জাটকা নিধনে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও বরিশালসহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে জাটকার অবাধ বিপণন অব্যাহত রয়েছে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, এবার মূল বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের ঘাটতিসহ জীববৈচিত্র্যের নানা পরিবর্তনের সাথে হাইড্রো-মেট্রোলজিক্যাল সমস্যায় ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্র পরিবর্তন হচ্ছে। ইতোপূর্বে বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালীর খেপুপাড়া, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, মনপুরা, ঢালচর, চরকুকরী-মুকরি, চর কচ্ছপিয়া ও সংলগ্ন সাগর এলাকায় ইলিশের যে বিচরণ ছিল, এবার তা অনেকটাই পূর্ব-দক্ষিণে সন্দীপের দক্ষিণ হয়ে টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন এলাকায় সরে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইলিশ অনেকটাই গহীন সমুদ্রে চলে গেছে। এর পেছনে উজানে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের সাথে সময়মত বৃষ্টিপাতের অভাবে পদ্মা, মেঘনা ও এর শাখা নদ-নদীগুলোতে প্রবাহ হ্রাসসহ পানির দূষণের মাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টি কাজ করছে বলেও মৎস্য বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।

মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আশরাফুল আলম জানান, চাঁদপুরে পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়ার মোহনায় যে স্রোত অতীতে ছিল, তা বিগত বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাবসহ উজানে প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ফলে লক্ষ্য করা যায়নি। উপরন্তু চাঁদপুর থেকে সাগর মোহনা পর্যন্ত দেড়শরও বেশি ডুবোচর সৃষ্টি হয়ে ইলিশের গতিপথ রুদ্ধ হচ্ছে। আবার যেখানে নদীর গভীরতা বেশি সেখানে নৌপথের মূল চ্যানেল হওয়ায় জেলেরা জাল ফেলতে পারছেন না। এমনকি শীত মৌসুমে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে নেমে যাওয়ার পাশাপাশি লাগাতার মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশার কারণে জেলেরা সাগর ও নদ-নদীতে নামতে না পারায় ইলিশ সরবরাহে ব্যাপক ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছে।

ড. আশরাফুল আলমের মতে, অতিমাত্রায় শিল্প ও মনুষ্য বর্জ্য অপসারণের ফলে নদ-নদীতে ইলিশের প্রধান খাবার ফাইটো প্ল্যাঙ্কটন ও জু-প্ল্যাঙ্কটনের ঘাটতি অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এবার প্রকট আকার ধারণ করেছে। যেখানে প্রতি লিটার পানিতে ফাইটো প্ল্যাঙ্কটন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার থাকার কথা, সেখানে তা দেড় হাজারের নিচে এবং জিও প্ল্যাঙ্কটন ১৫শ’ স্থলে কোন কোন নদীতে ২-৩ শ’তে নেমে এসেছে। ফলে খাবারের অভাবেও ইলিশ সাগরের উপকূল অতিক্রম করে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে আসছে না। পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে অতিরিক্ত তাপ প্রবাহের ফলেও ইলিশ সাগর থেকে নদীমুখী হচ্ছে না। ইলিশ বিচরণের জন্য যেখানে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানির তাপমাত্রা ২৮-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকা প্রয়োজন, সেখানে বিগত গ্রীষ্ম মৌসুমে তা ৩৪-৩৫ ডিগ্রি অতিক্রম করেছে। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য অনুষদের অধ্যাপক ড. সাজেদুল ইসলাম ইলিশের বংশ বিস্তারসহ নদ-নদীর হাইড্রো-মেট্রোলজিক্যাল বিষয়গুলোর প্রতি নজরদারির আহবান জানিয়েছেন।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ এবি সিদ্দিকের মতে, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ সীমায় প্রতিবছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই ছাড়াও আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগে ও পরের ২২ দিন সবধরনের মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ থাকলেও ভারত ও মিয়ানমারের জেলেরা এ সময় অবাধে বাংলাদেশের নৌ-সীমা থেকে মাছ ধরে নিয়ে যায় অভিযোগ রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের জলসীমায় শুধুমাত্র ১৫ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। মিয়ানমারেও জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ। এ দুটি দেশের জেলেরা বাংলাদেশের নিষিদ্ধকালীন বঙ্গোপসাগরের নৌ-সীমা অতিক্রম করে অবাধে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাই প্রতিবেশী দেশের সাথে সমতা রেখে বাংলাদেশেও মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণার সময় বিবেচনা জরুরি হয়ে পড়েছে।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৫:০৬ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

দৈনিক গণবার্তা |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদকঃ শাহিন হোসেন

বিপিএল ভবন (৩য় তলা ) ৮৯, আরামবাগ, মতিঝিল, ঢাকা ।

মোবাইল : ০১৭১৫১১২৯৫৬ ।

ফোন: ০২-২২৪৪০০১৭৪ ।

ই-মেইল: ganobartabd@gmail.com