আয়াতটি যদিও একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে নাযিল হয়েছে, কিন্তু এর বার্তা-বলয় অনেক ব্যাপক। সব ধরনের অন্যায় ও গর্হিত কথা ও কাজের প্রচার এ আয়াতের নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও সহজলভ্যতার এই যুগে কোনো কিছু প্রচার করা বা ছড়িয়ে দেওয়া খুবই সহজ। চাইলে মুহূর্তেই একটা বিষয় পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেওয়া যায়। নিত্যদিনই নতুন নতুন বিষয় বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে মানুষের মাঝে ছড়িয়েও পড়ছে; এরমধ্যে ভালোর চেয়ে মন্দের পরিমাণই বেশি। চিত্তাকর্ষক পুঁতিগন্ধময় হাজারও বিষয়ের সয়লাব ঘটছে।
মুসলিম সমাজ ও পরিবারগুলোতেও এর মাত্রা বেড়ে চলেছে। অনেকে জেনেবুঝেই অনাচার ও পাপাচারের দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং তা ছড়িয়ে দিচ্ছে; অনেকে আবার অসতর্কতা ও অসচেতনতায় এসবে জড়িয়ে পড়ছে। শয়তান গুনাহের কাজগুলোকে লোভনীয় রূপে মানুষের কাছে উপস্থাপন করে; এর মোহে পড়ে বহু মুসলমান নিজেদের দ্বীন-ঈমান ও আখেরাতকে বরবাদ করছে। আল্লাহতায়ালা উক্ত আয়াতে যারা মন্দ কথা ও কাজের প্রচার-প্রসার ঘটায় এবং তাতে ইন্ধন জোগায় তাদের ব্যাপারে বলেছেন, ‘তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে আছে যন্ত্রণাময় শাস্তি।’
কোরআন মাজিদের এ বার্তায় পাপ ও গুনাহ ছড়ানোর সবধরনের মাধ্যমই অন্তর্ভুক্ত। কথায়, লেখায় কিংবা ছবি বা ভিডিও ইত্যাদি বানিয়ে সব ধরনের অশালীনতা ও অশ্লীলতা ছড়ানো নিষেধ। গালিগালাজ করা, মিথ্যা কথা বলা, কাউকে অপবাদ দেওয়া বা কারো গীবত করা- এর সবগুলোই মুখের কথায় অশ্লীলতা ছড়ানোর প্রকার। আর সংবাদপত্র ও বই-পুস্তকে মন্দ বা অন্যায় কথা লেখা, চিঠি বা দেয়ালে লেখা কিংবা পোস্টার ও বিলবোর্ডে লেখা অথবা চিত্র আঁকা ইত্যাদির মাধ্যমে অশ্লীলতা ছড়ানোর প্রকার। এসব কিছুই আয়াতের নিষেধাজ্ঞায় শামিল।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ইদানীং বাছবিচার ছাড়া সবকিছুই ছড়িয়ে দেওয়ার অসুস্থ মানসিকতা ব্যাপক হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে প্রচলিত শব্দ হচ্ছে ‘ভাইরাল করা।’ এটা মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে যা মনে চায় তাই বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। মন্দ-ঘৃণিত-অশালীন কত বিষয় কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় অবলীলায় প্রচার করছে।
ইসলামে গুনাহের কাজ পরিহার করার নির্দেশনা তো আছেই, অন্যের দোষ-ত্রুটির ক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষা হলো, অন্যের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখা।
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যের দোষ গোপন রাখতে বলেছেন। কোন্ দোষ কতটুকু প্রকাশ করা হবে, সে ব্যাপারেও কোরআন-হাদিসে বিস্তারিত নির্দেশনা রয়েছে। ইসলামের এ মহান শিক্ষা ভুলে আমাদের অনেক যুবক এখন ‘ভাইরাল’-এর রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, অশ্লীলতা ছড়িয়ে দিতে একে অন্যের সহযোগী হচ্ছে। অথচ আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা নেক কাজ ও তাকওয়া অবলম্বনের ক্ষেত্রে একে অন্যের সহযোগিতা করবে, গুনাহ ও জুলুমের কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না। আল্লাহ্কে ভয় করে চলো। নিশ্চয়ই আল্লাহর শাস্তি অতি কঠিন।’ -সূরা মায়েদা: ২
আল্লাহতায়ালা অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘কিছু মানুষ এমন, যারা অজ্ঞতাবশত আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিচ্যুত করার জন্য এমন সব ‘অবান্তর কথা’ ক্রয় করে, যা আল্লাহ সম্পর্কে উদাসীন করে দেয় এবং তারা আল্লাহর পথ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। তাদের জন্য আছে লাঞ্চনাকর শাস্তি।’ -সূরা লুকমান: ০৬
বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় সালাফ থেকে বর্ণিত আছে, আল্লাহর পথ থেকে এবং ঈমান-আমল থেকে বিচ্যুত করে- এমন যেকোনো কিছু ক্রয় করাই আয়াতের নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত।
একে তো এই আয়াতের ব্যাপকতা অনুযায়ী আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুতকারী কোনো কিছুই কেনা যাবে না। সেই সঙ্গে এ জাতীয় কিছু কেনার দ্বারা প্রথমোক্ত আয়াতে বর্ণিত মন্দ ও অশালীনতা প্রচারের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করা হয়। যার পরিণামে আয়াতে ভয়াবহ শাস্তির কথা ঘোষিত হয়েছে।
আজকাল অনেকে প্রগতি-উৎকর্ষ-স্বাধীনতা-অধিকার-সৃজনশীলতা ইত্যাদি শব্দের ছাতা মেলে তার ছায়ায় যাচ্ছেতাই করার প্রয়াস পাচ্ছে। তারা প্রগতির নামে অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ গল্প-উপন্যাস, চিত্রাঙ্কন ও ভিডিও এবং অশিষ্ট ভাষণ-বক্তব্য ও মতবাদ ইত্যাদিকে বিচার বিশ্লেষণ ও দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে বলতে চাচ্ছে। এ সব মাধ্যমে মুসলিম সমাজের শিরা-উপশিরায়ও অনাচার-পাপাচার ছড়িয়ে পড়ছে এবং তা জীবননাশী রোগের মতো জেঁকে বসছে। সর্বত্র অশালীনতা ও অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো, এসব গল্প-উপন্যাসের বই, ধারণকৃত ভিডিও এবং সংবাদপত্র তথা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া। এই মিডিয়াগুলো প্রায় সারাক্ষণই এমন সংবাদ ও ভিডিও প্রচার করতে থাকে, যা মানুষের জন্য জাগতিকভাবেও নানা দিক থেকে ক্ষতিকর এবং মুসলমানদের জন্য দ্বীন-ঈমানের হন্তারক। অনেক ক্ষেত্রে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রসিকতা ও ঠাট্টা-বিদ্রূপও করা হয়।
এসবের বহুমুখী ক্ষতিকর প্রভাবে মুসলমানরা দিন দিন দ্বীনী ও ঈমানি মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলছে। গুনাহ সম্পর্কে ভয়-ভীতি কমে গিয়ে তা সহনীয় হয়ে যাচ্ছে। তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক মুসলমান ছেলেমেয়েও তাদের মতো কার্যকলাপে সক্রিয় হওয়ার কথা ভাবছে। আল্লাহভীতি ও আখেরাতের পরিণতির কথা ভুলে চোখ, কান, হাত, মুখ তথা সর্বাঙ্গ দিয়ে গুনাহে জড়িয়ে যাচ্ছে। পরিণামে আখেরাতের অবর্ণনীয় শাস্তি তো আছেই।
এ সব পাপাচারে লিপ্ত হওয়া এবং অন্যদের মধ্যে অশালীনতা ছড়িয়ে দেওয়ার গুনাহের কারণে দুনিয়ার জীবন থেকেও আল্লাহর রহমত-বরকত চলে যায়; জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ যন্ত্রণাক্লিষ্ট। অথচ মুমিনের জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে তার চলন-বলনের ধরন এবং যাপিত জীবনের আদর্শিক রূপরেখা আল্লাহতায়ালা কোরআন কারিমে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহস্রাধিক হাদিসে সবিস্তারে বলে দিয়েছেন। অসংখ্য হাদিসে একথাও বর্ণিত হয়েছে যে, যখন সর্বত্র গুনাহ ও অশালীনতা ছড়িয়ে পড়বে, তখন একের পর এক ফেতনা, বিপদ-দুর্যোগ, মহামারি দেখা দেবে এবং সমাজে অশান্তি-অরাজকতা বিরাজ করবে। কাজেই মুমিনদের এসব বিষয়ে খুব সতর্ক থাকা প্রয়োজন এবং মুসলিম সমাজে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়া সব ধরনের অন্যায়-অশালীনতা রোধে চিন্তা-ভাবনা করা ও পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক।
Posted ৯:১৩ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫
দৈনিক গণবার্তা | Gano Barta