স্টাফ রিপোর্টার : ৩৫ বছর কোরিয়া জাপানের উপনিবেশ ছিল। হিরোশিমায় বোমা পড়ার সময় ছিল সেই উপনিবেশকাল। আনুমানিক ১ লাখ ৪০ হাজার কোরিয়ান সেসময় হিরোশিমায় বসবাস করতেন। হিরোশিমায় নিহতদের অন্তত ২০ শতাংশই ছিলেন কোরিয়ান। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকাল ৮টা ১৫ মিনিট। হিরোশিমার আকাশ দিয়ে পাথরের মতো নিচে নামছিল একটি পারমাণবিক বোমা—ঠিক তখনই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পথে ছিলেন লি জং-সুন। ৮৮ বছর বয়সী এই নারী এখনো হাত নেড়ে সেই স্মৃতিকে দূরে ঠেলতে চান। বিবিসির কাছে স্মৃতিচারণকালে দিনটি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা তখন কাজে যাচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ তিনি ফিরে এসে বললেন—দ্রুত পালাও। রাস্তাগুলো মৃতদেহে ভরে গিয়েছিল। কিন্তু আমি এতটাই স্তম্ভিত ছিলাম যে, শুধু কেঁদেছি। ১৫ হাজার টন টিএনটির সমান শক্তির বিস্ফোরণে পুরো হিরোশিমা নগরী এক নিমিষে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ৪ লাখ ২০ হাজার মানুষের সেই শহরে, বিস্ফোরণের পর পড়ে থাকা বিকৃত মৃতদেহগুলো চিনে নেয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। লি বলেন, ‘এই পারমাণবিক বোমা কতটা ভয়ঙ্কর অস্ত্র, বলার মতো না।’ ৮০ বছর হয়ে গেছে সেই দিনের। যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো মানব ইতিহাসে ‘লিটল বয়’ নামের পারমাণবিক বোমাটি ফেলে হিরোশিমার ওপর। সঙ্গে সঙ্গেই ৭০ হাজার মানুষ নিহত হয়। পরবর্তী কয়েক মাসে তেজস্ক্রিয়তা, পুড়ে যাওয়া ও পানিশূন্যতার কারণে আরো বহু মানুষের মৃত্যু হয়।হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমার ভয়াবহতা ও বিশ্বযুদ্ধের অবসান—এ নিয়ে নানা আলোচনা ও গবেষণা হলেও একটি দিক আজও তেমনভাবে আলোচিত হয়নি— হিরোশিমায় নিহতদের অন্তত ২০ শতাংশই ছিলেন কোরিয়ান। ৩৫ বছর কোরিয়া জাপানের উপনিবেশ ছিল। হিরোশিমায় বোমা পড়ার সময় ছিল সেই উপনিবেশকাল। আনুমানিক ১ লাখ ৪০ হাজার কোরিয়ান সেসময় হিরোশিমায় বসবাস করতেন। এই বোমা হামলায় যারা টিকে গেছেন, তারা ও তাদের বংশধরেরা এখনো সেই দিনের ছায়া বয়ে বেড়াচ্ছেন। দেহ-মনে জ্বলন্ত ক্ষত, সামাজিক বৈষম্য ও ন্যায়ের দাবিতে বহু দশকের সংগ্রাম তাদের। তবে এ ক্ষতের দায় কেউ নেয় না বলে জানালেন ৮৩ বছর বয়সী বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি শিম জিন-তায়ে। তিনি বলেন, ‘যারা বোমা ফেলেছে তারাও না, এমনকি যারা আমাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিল তারাও এ দায় নেয়নি। আমেরিকা কোনোদিন ক্ষমা চায়নি। জাপান যেন কিছুই জানে না। আর কোরিয়া? তারাও দায় এড়িয়ে চলে—আর আমরা পড়ে থাকি একা। বর্তমানে শিম বসবাস করেন দক্ষিণ কোরিয়ার হাপচন এলাকায়। এখানে পরমাণু বোমা থেকে বেঁচে যাওয়া বহু কোরিয়ান এসে বসতি গড়েছেন। জায়গাটি এখন ’কোরিয়ার হিরোশিমা’ নামে পরিচিত। লি জং-সুন বলেন, সেই দিনের ক্ষত তার শরীরে অসুস্থতা হয়ে রয়ে গেছে। তিনি এখন স্কিন ক্যান্সার, পারকিনসনস ও অ্যাঞ্জিনায় আক্রান্ত। তবে লিয়ের জন্য সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক, তার ছেলে হো-চাং লি কিডনি ফেইলিউরে ভুগছেন। ডায়ালাইসিস চলছে কিডনি প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায়। আর স্বাস্থ্যসমস্যা তেজস্ক্রিয়তার ফলাফল বলে অভিযোগ হো-চাং-এর। দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিবিসিকে জানিয়েছে, তারা ২০২০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত জেনেটিক তথ্য সংগ্রহ করেছে। ২০২৯ পর্যন্ত গবেষণা চালাবে। তারা বলেছে, যদি পরিসংখ্যানগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল আসে, তাহলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মকেও ‘ভুক্তভোগী’ হিসেবে বিবেচনার বিষয়ে ভাবা হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোরিয়ানদের অবস্থা ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো। সবচেয়ে কঠিন, নোংরা ও বিপজ্জনক কাজগুলো ছিল তাদের কাঁধে। বোমা হামলার পর পরবর্তী ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার ও মৃতদেহ সংগ্রহের কাজও প্রধানত কোরিয়ানদের ঘাড়েই পড়ে। ফলে তেজস্ক্রিয়তায় বেশি আক্রান্ত হন কোরিয়ানরা, চিকিৎসাও ছিল সীমিত। এতে মৃত্যুহারও হয় অসম। কোরিয়ানদের মধ্যে মৃত্যুর হার ছিল ৫৭ দশমিক ১ শতাংশ, যেখানে সামগ্রিক হার ছিল প্রায় ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশ। বোমা হামলায় প্রায় ৭০ হাজার কোরিয়ান আক্রান্ত হন। বছরের শেষ নাগাদ মারা যান প্রায় ৪০ হাজার। যুদ্ধের পর জাপান আত্মসমর্পণ করে, কোরিয়া স্বাধীন হয়। প্রায় ২৩ হাজার কোরিয়ান নিজ দেশে ফেরেন। কিন্তু দেশে এসেও তারা পায়নি স্বীকৃতি বা সমবেদনা।শিম বলেন, হাপচনে আগেই ছিল কুষ্ঠ রোগীদের একটি উপনিবেশ। তাই লোকে ভেবেছিল, পারমাণবিক বোমায় যারা জ্বলেছে, তারাও ওই রকম ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত। পরবর্তীতে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব পড়তে শুরু করে দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের ওপর। দ্বিতীয় প্রজন্মের একজন ভুক্তভোগী হান জাং-সুনের কোমরের হাড় ক্ষয়ে গেছে (অ্যাভাসকুলার নেক্রোসিস), তিনি হাঁটতে পারেন না। তার প্রথম সন্তান জন্ম থেকেই সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত। দীর্ঘ সময় ধরে কোরিয়ান সরকারও এই মানুষদের নিয়ে তেমন কিছু করেনি। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন তখন ছিল অগ্রাধিকার। কিন্তু ২০০৫ ও ২০১৩ সালের দুটি আলাদা গবেষণায় দেখা যায়—দ্বিতীয় প্রজন্মের মানুষরা বেশি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিষণ্নতা, হৃদরোগ ও রক্তস্বল্পতার কারণ তেজস্ক্রিয়তা।
গত মাসেই জাপানের হিরোশিমা শহরের কর্মকর্তারা প্রথমবারের মতো হাপচনে এসে স্মৃতিসৌধে ফুল দেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইউকিও হাতোইয়ামা ও অন্যান্য বেসরকারি ব্যক্তিরা আগে এলেও এবারই প্রথম সরকারি সফর। সফরকালে কোনো জাপানি কর্মকর্তা কোরিয়ানদের ওপর তাদের আচরণের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেননি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। জাপানি শান্তিকর্মী জুনকো ইচিবা বলেন, ২০২৫ সালে এসে জাপান ‘শান্তি’র কথা বলে। কিন্তু ক্ষমাহীন শান্তি কীসের শান্তি?ইচিবা আরো বলেন, জাপানি পাঠ্যবই এখনো কোরিয়াকে উপনিবেশ বানানোর ইতিহাস বা কোরিয়ান পরমাণু বোমা ভুক্তভোগীদের কথা উল্লেখ করে না। এভাবে অদৃশ্য করে দেয়াই সবচেয়ে বড় অবিচার।
Posted ২:০৭ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৫ আগস্ট ২০২৫
দৈনিক গণবার্তা | Gano Barta