গণবার্তা রিপোর্টার : বৈশ্বিক বাণিজ্য বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর শুল্কনীতি সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য এক অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান পোশাক রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশও এ সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়, যা গার্মেন্টসহ মূল রপ্তানি খাতকে এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছিল।কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতা ও বহুপক্ষীয় আলোচনার পর অবশেষে গতকাল ১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র শুল্কহার ৩৫ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশ সরকার ‘অর্থনীতির জন্য বড় স্বস্তি’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
বাংলাদেশের প্রধান উদ্বেগ
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (জগ)ে খাত দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮৫ শতাংশ জুড়ে আছে। এখানে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক সরাসরি যুক্ত। যুক্তরাষ্ট্র যদি ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করত, তবে বাংলাদেশের পণ্যের দাম বৈশ্বিক বাজারে বেড়ে যেত এবং ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিযোগী দেশগুলো
সুবিধা পেয়ে যেত। বাণিজ্য উপদেষ্টাসহ যুক্তরাষ্ট্রে সফরকারী দলের সদস্যরা জানিয়েছেন, এই শুল্কহার ২০ শতাংশে নামায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আবারও প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ফিরে পেয়েছে।
কোন মূল্যে এই স্বস্তি?
এটি নিছক শুল্ক হ্রাস নয়, বরং একধরনের বিনিময়মূলক সমঝোতা। আলোচনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দুটি বড় আমদানির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা হলোÑ২৫টি বোয়িং বিমান ক্রয়ের চুক্তি (আগে পরিকল্পনা ছিল ১৪টি)। দ্বিতীয়ত, কৃষিজাত পণ্য ৭০ লাখ টন গম, তুলা ও সয়াবিন আমদানির চুক্তি। এর মধ্যে ২২ লাখ টন গমের চুক্তি এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
এই প্রতিশ্রুতিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড ডেফিসিট কমানোর লক্ষ্যে দেয়া হয়েছে। বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি ছিল ‘উইন-উইন ডিল’, যেখানে বাংলাদেশ রপ্তানি স্বস্তি পেল এবং যুক্তরাষ্ট্র পেল বিশাল অর্ডার।
স্বস্তি সাময়িক নাকি স্থায়ী?
অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, ২০ শতাংশ শুল্ক তাৎক্ষণিক বিপর্যয় ঠেকালেও বাংলাদেশকে এখনই বিকল্প বাজার ও বৈচিত্র্যময় রপ্তানি পণ্য উন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে। তার মতে, শুল্ক হারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা রপ্তানিকে দীর্ঘ মেয়াদে ঝুঁকির মুখে ফেলে। এই চুক্তি সাময়িক সুরক্ষা দিলেও ভবিষ্যতের জন্য নতুন বাজার খুঁজে বের করা অপরিহার্য।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খানের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পাল্টা শুল্ক ৩৫ থেকে কমে ২০ শতাংশ হয়েছে, যেক্ষেত্রে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থানেই রয়েছে। ফলে ধীরে ধীরে এ চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে পারবে। তিনি বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে এখন আমাদের শুল্কহার প্রায় সমান, অথবা কিছুটা কমÑএটি আমাদের জন্য স্বস্তির খবর।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বায়ারদের (ক্রেতা) এখন আগের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। এতে তাদের ক্রয়ক্ষমতা এবং স্থানীয় ভোক্তাদের ভোগব্যয় কমে যেতে পারে। ফলে প্রাথমিকভাবে আমাদের রপ্তানিতে কিছুটা ধাক্কা লাগতে পারে এবং মূল্য নিয়ে চাপ তৈরি হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ আবার এ সমস্যা কাটিয়েও উঠতে পারবে, কেননা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে আমরা বলতে গেলে স্বাভাবিক অবস্থানেই আছি।
বাণিজ্য উপদেষ্টার মতে, এই সিদ্ধান্ত দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে স্থিতিশীলতা ফেরাতে সহায়তা করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নতুন সুযোগ
শুল্ক হ্রাসের ফলে বাংলাদেশি পোশাকের মূল্য প্রতিযোগিতা আবারও ফিরে এসেছে। নতুন অর্ডার বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে, যা ৪০ লাখ শ্রমিকের জীবিকা রক্ষায় সহায়ক হবে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাকের বাজারমূল্য ভারতের সমান হয়ে যাচ্ছে, ফলে হারানো অর্ডার ফিরিয়ে আনার সুযোগ তৈরি হবে। তবে যদিও সমঝোতাটি বড় সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে, তবুও কিছু ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে, যেমন বাণিজ্য সম্পর্ক একপক্ষীয় হয়ে পড়তে পারে। বিমান ও গম ক্রয় চুক্তি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করতে পারে এবং মার্কিন প্রশাসনে পরিবর্তন এলে নীতির হঠাৎ পরিবর্তন নতুন সমস্যার জন্ম দিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য তাৎক্ষণিক স্বস্তি এনেছে। তবে এটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়। বাংলাদেশকে এখন রপ্তানি বৈচিত্র্য বাড়ানো, নতুন বাজার খোঁজা এবং বাণিজ্যিক কূটনীতিকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এই তিনটি ক্ষেত্রে তৎপর হতে হবে। তবেই বৈশ্বিক বাণিজ্যনীতির যে কোনো পরিবর্তনের মুখেও দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকবে।
Posted ১০:৩৬ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ০২ আগস্ট ২০২৫
দৈনিক গণবার্তা | Gano Barta