আজ, শুক্রবার


১১ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৭শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম
শিরোনাম

যুদ্ধ আমাদের কোন অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছে?

সোমবার, ০৫ মে ২০২৫
যুদ্ধ আমাদের কোন অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছে?
সংবাদটি শেয়ার করুন....

স্টাফ রিপোর্টার :

১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত ২০ বছর স্থায়ী ভিয়েতনাম যুদ্ধ ছিল ২০ শতকের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম দীর্ঘ সামরিক সংঘর্ষ। এই যুদ্ধে প্রায় ৩.৮ মিলিয়ন মানুষের প্রাণহানি ঘটে এবং এটি দক্ষিণ ভিয়েতনামের মার্কিন সমর্থিত সরকারের পরাজয় এবং উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট বাহিনীর বিজয়ের মাধ্যমে শেষ হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবাই যুদ্ধের মহাবিভীষিকা, বিশেষত পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞ দেখে মনে করেছিলেন, বিশ্ব বোধহয় আর কোনও যুদ্ধে জড়াবে না। ভিয়েতনাম যুদ্ধ মানুষের সেই আশা বিনষ্ট করে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ভিয়েতনাম যুদ্ধের ৫০ পরও বিশ্ব যুদ্ধ ও সংঘাতে জর্জরিত। খোদ জাতিসংঘোর পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, শুধু ২০২৩ সালেই ১৭০টির বেশি সশস্ত্র সংঘাত ঘটেছে। সেই বছর শেষে পৃথিবীর ১২ কোটি মানুষকে জোর করে উৎখাত করা হয়েছে তাদের বাসভূমি থেকে যুদ্ধ কিংবা সংঘাতের মাধ্যমে। সেই সব সংঘাতে সামগ্রিক ভাবে প্রকৃতি ও পরিবেশের উপরও বিশাল প্রভাব পড়ছে।

সভ্যতার ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বিনাশী হিসাবে চিহ্নিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তাতে সেনা ও সাধারণ নাগরিক নিয়ে প্রায় ৮ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। এবং সেই যুদ্ধ থেকেই পরমাণু বিস্ফোরক তথা বোমা এবং নানাবিধ রাসায়নিকের যে ব্যবহার শুরু হয়, তা পরবর্তী বছরগুলোতে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এখন ড্রোন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রযুক্তি আরও শক্তিশালী হয়েছে, যা অবাধে ব্যবহার করা হচ্ছে মানুষের বিরুদ্ধে। মানুষের পাশাপাশি বিশ্ব পরিবেশের উপর এক অনিবার্য ও চিরস্থায়ী কুপ্রভাব ফেলেছে যুদ্ধ ও সংঘাত।

এতো কুফলের পরেও যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। বিশ্বে একাধিক যুদ্ধ ও সংঘাত চলছে এবং বহু স্থানেই যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। বাস্তবতা হলো এই যে, যুদ্ধ—মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক অবিচ্ছিন্ন, কিন্তু ভয়াবহ অনুষঙ্গ। যুগে যুগে প্রযুক্তি যত অগ্রসর হয়েছে, যুদ্ধও তত ভয়ংকর ও ব্যাপক হয়ে উঠেছে। একদিকে চলছে আধুনিকতা, উন্নয়ন ও বিজ্ঞানের জয়গান, অন্যদিকে ধ্বংসের নিনাদ। পৃথিবীর বহু প্রান্তে মানুষ বোমা ও অস্ত্রের আঘাতে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে কিংবা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। একই সঙ্গে নির্মূল হচ্ছে পরিবেশ, প্রকৃতি, এবং জনজীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। যে লেবানন, ফিলিস্তিন ছিল ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী চিরবসন্তের চিরসবুজ জনপদ, যেখানে গভীর নীল আকাশের তলে নির্মল বাতালে খেলা করতো ওলিভ ও সিডর গাছের ডালপালা, সেখানে এখন ধ্বংসের মাতম। সভ্যতার প্রাচীন কেন্দ্র ইরাক, সিরিয়ায় মৃত্যুর হাতছানি। এমনকি, আমাদের দেশের পর্যটন আকর্ষণ কক্সবাজারের প্রান্তিক পাহাড়ি অঞ্চলগুলো মায়ানমারের সংঘাতের কারণে সৃষ্ট শরণার্থী সমস্যায় বিরাণভূমি।

ফলে বর্তমানে গাজা, ইউক্রেন বা অন্যান্য যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়, কেবল মানুষ নয়, প্রকৃতিও যুদ্ধে রক্তাক্ত। গাছপালা, বন্যপ্রাণ, নদীনালা, বনভূমি—সবকিছুই যেন একটি অদৃশ্য আগ্রাসনের শিকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গাজার মতো অঞ্চলে মাত্র তিন মাসের মধ্যে শিশুদের মধ্যে মারাত্মক শ্বাসজনিত সংক্রমণ ও ডায়রিয়ার মতো রোগ ছড়িয়েছে, যার মূল কারণ যুদ্ধ-সৃষ্ট পরিবেশগত বিপর্যয়। বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা ১৯১৪ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ১৯৩টি কেস স্টাডি বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, যুদ্ধের ফলে মানুষের পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বনভূমি (৩৪%) এবং ভূমি (২৩%)।

অতএব, যুদ্ধ কেবল শারীরিক মৃত্যুই আনে না, তার হাত ধরে আসে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ধ্বংস, বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব, খাদ্য নিরাপত্তার সংকট, এবং বাতাসের দূষণ। পরমাণু অস্ত্র, রাসায়নিক বোমা কিংবা উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক দ্রব্য—এসব কিছুর প্রভাবে জল, মাটি, বাতাসের মধ্যে এমন সব বিষাক্ত উপাদান ছড়িয়ে পড়ে যা দীর্ঘমেয়াদে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে প্রভাবিত করে।

এমনকি, উষ্ণায়ন বা জলবায়ু সংকটও যুদ্ধের অনিবার্য উত্তরাধিকার। বর্তমানে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের চরম ঝুঁকিকে আরও বাড়াচ্ছে যুদ্ধ ও সংঘাত। যুদ্ধ ও সংঘাতজনিত দূষণ ও উষ্ণতা বৈশ্বিক জলবায়ু বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ রূপে চিহ্নিত হচ্ছে। আধুনিক অস্ত্র ও যন্ত্রপাতির মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়, তা পৃথিবীর উষ্ণায়নে সরাসরি অবদান রাখছে। যুদ্ধের কারণে অকাতরে বন ধ্বংস হচ্ছে, সবুজ হ্রাস পাচ্ছে, যা আবার কার্বন শোষণের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। এই প্রক্রিয়াই আমাদের বর্তমানকে কলুষিত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যাচ্ছে এক বিপজ্জনক ও অনিশ্চিত পৃথিবী।

এ কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মানবতা থেকে বিচ্যুতি যুদ্ধোন্মাদনার প্রধান কারণ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আধুনিকতা আমাদেরকে উন্মাদনা থেকে থামাতে পারছে না কেন? বর্তমানে ‘আধুনিক ও উন্নত’ সভ্যতা নামে পৃথিবী কী সত্যিই এগোচ্ছে, নাকি ইতিহাসের এক অন্ধকারতম গহ্বরে প্রবেশ করছে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে আজকের ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা গাজায় গণহত্যা, প্রতিটি যুদ্ধেই মানবতাহীনতা প্রকটতর হয়ে সামনে এসেছে এবং ব্যাপক প্রাণহানির পাশাপাশি প্রাকৃতিক কাঠামো ধ্বংসের নৃশংসতম চিত্র দেখা গিয়েছে। মানুষকে হত্যা করেই যুদ্ধ থেমে যাচ্ছে না; প্রকৃতিকে ধ্বংস করে অন্ধকার ঘনিয়ে আনছে। ফলে যুদ্ধ এখন আর জয় বা পরাজয়ের পথ নয়, মানুষ ও প্রকৃতি ধ্বংসের রাজপথ। সেই ধ্বংসের রাজপথ বেয়ে যুদ্ধ ও সংঘাত আজকের পৃথিবী ও মানবতাকে কোন অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছে? এই অন্ধকারের দিকে এগিয়ে চলা সভ্যতাকে কে থামাবে? বাঁচাতে মানুষ ও প্রকৃতিকে? কে দেখাবে এমন ভালোবাসা ও সদিচ্ছা?

এর উত্তর আমরা কেউই জানি না। কিন্তু আমরা সবাই প্রত্যাশা করি, যুদ্ধ ও সংঘাত বন্ধ হোক। মানুষ ও প্রকৃতি রক্ষা করা হোক। যুদ্ধবাজদের হিংসা, ঘৃণা, উন্মাদনার বিরুদ্ধে মানবতা, খালোবাসা ও সম্প্রীতির জয় হোক।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ০৫ মে ২০২৫

দৈনিক গণবার্তা |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ

সম্পাদকঃ শাহিন হোসেন

সহকারী সম্পাদকঃ মোঃ শাহ পরান হাওলাদার

বিপিএল ভবন (৩য় তলা ) ৮৯, আরামবাগ, মতিঝিল, ঢাকা ।

মোবাইল : ০১৭১৫১১২৯৫৬ ।

ফোন: ০২-২২৪৪০০১৭৪ ।

ই-মেইল: ganobartabd@gmail.com