স্টাফ রিপোর্টার : শুধু টিয়ানের নয়, পুরো গ্রামের মানুষের সকাল শুরু হয় এই পোস্তগাছে। কেউ জানে না এই আফিম কোথায় যায়, কিন্তু সবাই জানে যে এছাড়া আর কোনো পথ নেই। শান প্রদেশের উঁচু টিলায় গরম বাতাসে থমকে থাকা দুপুর। মাথা নিচু করে বসে আছেন বছর কুড়ির টিয়ান উইন ন্যাং। দু’হাতে ধরে রাখা দুটি কালচে রঙের বলকেই এখন তার ভবিষ্যৎ বলে মনে হচ্ছে। কাঁচা আফিম— এক কেজিতে মিলতে পারে ২৫০ ডলার। আশপাশের মাঠে তখনো পোস্ত গাছে ক্ষুর চালাচ্ছেন অন্য কৃষকেরা। গুটি চিরে দুধের মতো তরল বের হয়, শুকিয়ে জমলে সেটিই তুলে রাখা হয় আগাম বিক্রির জন্য। শুধু টিয়ানের নয়, পুরো গ্রামের মানুষের সকাল শুরু হয় এই পোস্তগাছে। কেউ জানে না এই আফিম কোথায় যায়, কিন্তু সবাই জানে যে এছাড়া আর কোনো পথ নেই। আফিম চাষ এখন সে নিষিদ্ধ কিছু নয়। বরং বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছে তাদের জীবনে। টিয়ান উইন ন্যাং জানিয়েছেন, এসব আফিম মূলত কিনে নেয় চীনা ক্রেতারা। পরে সেগুলো ল্যাবে গিয়ে হেরোইন তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। পেকন শহরের আশপাশের গ্রামে এমন হাজারো কৃষক এখন এই চাষের সঙ্গে যুক্ত। একজন নারী শ্রমিক বলছিলেন, ‘বেঁচে থাকার জন্যই এসব চাষবাষ। আর কোনো রাস্তা নেই। শান প্রদেশের সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকা বহুদিন ধরেই মাদক চক্রের দখলে। এই রুট দিয়ে মাদক পৌঁছে যায় থাইল্যান্ড, চীন ও লাওস সীমান্তে। এই চক্রে নাম আছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী, বিদ্রোহী দল, স্থানীয় অপরাধী গোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা সংস্থা অ্যাডভান্স মিয়ানমারের পরিচালক মার্ক ফারম্যানার জানিয়েছেন, সেনাবাহিনী শুধু অনুমতি দেয় না। বরং বহু ক্ষেত্রেই নিজেরাও লাভবান হয়। সবচেয়ে বড় চক্র ‘স্যাম গোর’ নামের এক সিন্ডিকেট, যার নেতৃত্বে ছিলেন চীনের গ্যাং নেতা টসে চি লপ। তাকে ২০২১ সালে গ্রেফতার করা হলেও, তাদের সিন্ডিকেট এখনো বহাল তবিয়তেই আছে। ২০২৩ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রেকর্ড ১১০ কোটি মেথ বড়ি (মেথামফেটামিন) জব্দ হয়েছে। তালেবান সরকার আফগানিস্তানে পোস্ত চাষ নিষিদ্ধ করায় মিয়ানমার এখন আফিম উৎপাদনের শীর্ষে। জাতিসংঘ বলছে, ২০২৩ সালে এখানে ৪৭ হাজার হেক্টর জমিতে পোস্ত চাষ হয়েছে, যার মধ্যে কাঁচা আফিম উৎপাদিত হয়েছে ৯৯৫ টন। এটি ২০২১ সালের তুলনায় ১৩৫ শতাংশ বেশি। এর বাজারমূল্য প্রায় ৫৮৯ মিলিয়ন থেকে ১ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনের ফলাফল অনুযায়ী, এই চাষ যারা করছেন, তারা চায়নি এই পথে আসতে। দুর্ভিক্ষ, সহিংসতা, রাষ্ট্রীয় সেবা না থাকা— সবকিছু মিলেই মানুষ বাধ্য হয়েছে। পেকনের গ্রামে এমন একজন বলছিলেন, ‘এটা আমাদের আয়ের একমাত্র উৎস। এই আয় না হলে আমাদের শিশুরা খাবে কী পেকনের বেশ কিছু এলাকা এখন বিদ্রোহীদের দখলে। তারা জানিয়েছে, যুদ্ধ শেষ হলে মাদকের এই চক্র তারা বন্ধ করবে। কেএনডিএফের উপপ্রধান মাওই বলেন, ‘বর্মি সেনারা ধরা পড়লে তাদের শরীরে মেথ পাওয়া যায়। তারা জানায়, অফিসাররাই তাদের বড়ি দেয়, যেন তারা যুদ্ধক্ষেত্রে আরো আগ্রাসী হতে পারে। কেএনডিএফের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় এখন চলছে মাদকবিরোধী তল্লাশি। ট্রাক থামিয়ে, যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ইয়াবা খোঁজা হচ্ছে। পেকনের জঙ্গলে কেএনডিএফ পরিচালিত একটি ছোট কারাগারে বেশ কয়েকজন ইয়াবা পাচারকারীকে আটকে রাখা হয়েছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাদের মধ্যে আন্তন লি নামের একজন থাইল্যান্ড সীমান্তে ১০ হাজার পিস ইয়াবা পাচার করছিলেন।একদিকে সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণে ধ্বংস হচ্ছে স্কুল, মন্দির, হাসপাতাল। অন্যদিকে বিদ্রোহীরাও চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিরোধ। এর মধ্যেই কেএনডিএফে ও স্থানীয় পুলিশ নিজেদের সামর্থ্যে মাদকের বিরুদ্ধে লড়ছে। যদিও সীমাবদ্ধতা অনেক। তবুও তারা জানিয়েছে, এটা কেবল অস্ত্রের যুদ্ধ নয়। এটা নেশার বিরুদ্ধে লড়াই। বাঁচতে চাওয়া মানুষেরা মাদকে জড়াচ্ছে। আর তাদেরই আরেক দল লড়ছে সেই বিপদের বিরুদ্ধে।এই লড়াই এখন মিয়ানমারের ভেতরে আরো গভীর এক যুদ্ধ, যেখানে হারছে দেশ, ভাঙছে সমাজ, আর মানুষ কেবল টিকে থাকতে চাইছে জীবনযুদ্ধে।
Posted ৭:০৩ অপরাহ্ণ | সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫
দৈনিক গণবার্তা | Gano Barta