আজ, Sunday


১২ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৭শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম
শিরোনাম

কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকে আরও কুক্ষিগত করছে জ্বালানি বিভাগ!

বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫
কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকে আরও কুক্ষিগত করছে জ্বালানি বিভাগ!
সংবাদটি শেয়ার করুন....

নিজস্ব প্রতিবেদক :

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা, সে লক্ষ্যেই নানান উদ্যোগ দৃশ্যমান। কিন্তু সরকারের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ঠিক উল্টো পথে হাটা দিয়েছে। তারা ক্ষমতাকে আরও কেন্দ্রীভূত ছোট করে বললে কুক্ষিগত করার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে ইস্যু করা একাধিক পত্রের প্রেক্ষিতে এমন মন্তব্য করেছেন জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্টরা। জ্বালানি বিভাগের করা নতুন আদেশের ফলে বিতরণ কোম্পানিগুলো ক্ষমতা জিরোতে নামিয়ে আনা হয়েছে। মূলত তাদের আর কোন ক্ষমতাই থাকছে না।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সর্বশেষ ২১ এপ্রিল ইস্যু করা এক চিঠিতে বলা হয়েছে, শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণিতে নতুন গ্যাস সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে পুর্বানুমতি গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ১৬ এপ্রিল সভার রেফারেন্স দিয়ে লেখা চিঠিতে, শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণিতে নতুন গ্যাস সংযোগ প্রদানের বিষয়ে কতিপয় সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রদান করা হয়। উক্ত নির্দেশনা মোতাবেক জরুরি প্রয়োজনে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে কেস টু কেস ভিত্তিতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের পুর্বানুমতি সাপেক্ষে গ্যাস সংযোগ প্রদান করা যেতে পারে। বিষয়টি সকল গ্যাস বিপণন ও বিতরণ কোম্পানিকে অবহিত করার জন্য পেট্রোবাংলা নির্দেশ দেওয়া হয়।

এর আগে ১৬ এপ্রিল উপসচিব রুবায়েত খান ৫ দফা নির্দেশনা দিয়ে একটি চিঠি ইস্যু করেছেন। ওই চিঠিতে বলা হয়, গ্যাস সংযোগ প্রদানের আবেদন বিবেচনার ক্ষেত্রে আবেদনসমুহকে নতুন সংযোগ, লোডবৃদ্ধি এবং প্রতিশ্রুত এই ৩ভাগে বিভক্ত করতে হবে। অতপর গ্যাস বিতরণ কোম্পানিসুহকে কর্তৃক গ্যাসের পর‌্যাপ্ততা বিবেচনায় নিয়ে একটি অগ্রাধিকার তালিকা প্রস্তুত করে জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলায় প্রেরণ করতে হবে। নতুন সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রাহকের গ্যাস প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।

নতুন সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রধান উদ্দেশ্যে হবে রাজস্ব বৃদ্ধি করা, এ ক্ষেত্রে প্রতিটি সংযোগের অর্থনৈতিক প্রভাব পর‌্যালোচনা করতে হবে। শিল্প শ্রেণিতে নতুন সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে পরিকল্পিত শিল্পাঞ্চল এবং রপ্তানিমুখী শিল্পকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, এরূপ নতুন সংযোগ অথবা লোডবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে যে অতিরিক্ত গ্যাস বরাদ্দ প্রয়োজন হবে তা নিরূপণ করে যথাসময়ে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

প্রথম দফার চিঠিতে বিষয়টি কিছুটা ধোঁয়াশা থাকলেও পরের চিঠিতে গ্যাস সংযোগের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের পুর্বানুমতির বিষয়টি স্পষ্ট করে দেওয়া হয়। আর এখানেই আপত্তিটা উঠতে শুরু করেছে। তাহলে বিতরণ কোম্পানির কাজটি কি। তাদের উচ্চ পর‌্যায়ের বোর্ডেরই বা কাজ কি। যে বোর্ডগুলোতে প্রধান উপদেষ্টার কার‌্যালয়ে সচিব থেকে শুরু করে অনেক সিনিয়র সচিব রয়েছেন। রযেছেন একাধিক অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্মসচিব, তারাকি তাহলে শুধু মন্ত্রণালয়ে প্রেসক্রিপশন অনুমোদন দিবেন!

আবার প্রথম দফায় ইস্যু করা চিঠির পঞ্চম দফায় বলা হয়েছে, “নতুন সংযোগ অথবা লোডবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে যে অতিরিক্ত গ্যাস বরাদ্দ প্রয়োজন হবে তা নিরূপণ করে যথাসময়ে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে”। বিষয়টি যেনো এমন, কালকে তিতাস কিংবা কর্নফূলী নতুন গ্যাস সংযোগ অনুমোদন দিবে, পরদিন থেকে পেট্রোবাংলা এলএনজি আমদানি বাড়িয়ে দিবে। যাতে বাড়তি গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়।

অথচ বাস্তবতা হচ্ছে দেশে মহাবিপদ সংকেত দেখা দিলেও দৈনিক ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস আমদানি করার কোন ‍সুযোগ নেই। নতুন এফএসআরইউ অথবা ল্যান্ডবেজড এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন না হওয়া পর‌্যন্ত। এফএসআরইউ করতে গেলে কাজ শুরুর পর কমপক্ষে ২৪ মাস, আর ল্যান্ডবেজড টার্মিনালের জন্য লাগবে ৫ বছর। বর্তমানে ১ হাজার থেকে ১০৫০ মিলিয়ন পর‌্যন্ত আমদানি করা হচ্ছে।

এখানে আরেকটি বিষয় রয়েছে, মনে হচ্ছে দেশে কোন গ্যাস সংকট নেই। বাড়তি লোড অনুমোদন হলে সেটুকু চাহিদা পেট্রোবাংলা সামাধান করলেই মিটে যাবে। কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, (পেট্রোবাংলার হিসাব মতে) দেশের প্রতিশ্রুত (ইতোমধ্যে অনুমোদিত) গ্রাহকদের গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ৫৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট, আর সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে মাত্র ২৭০০ মিলিয়নের মতো। তারপর অনেক যদি কিন্তু রয়েছে।

অর্ধেকের বেশি এখনও ঘাটতি রয়েছে। প্রতিশ্রুত গ্রাহকদের চাহিদা পুরণ করতে হলে দৈনিক আরও ২৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি করা দরকার। যদিও পেট্রোবাংলা মনে করে গ্যাসের প্রকৃত চাহিদা ৪০০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। সে হিসাব ধরলেও ঘাটতি প্রায় ১৩০০ মিলিয়ন। পুর্নসক্ষমতায় এলএনজি আমদানি করলে সরবরাহ বাড়বে মাত্র ৫০ মিলিয়নের মতো।

প্রধান দফার চিঠির বিষয়ে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান রেজানুর রহমানের মুখোমুখি হয়েছিল বার্তা২৪.কম। তিনি বলেছিলেন, কারো ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে না। পেট্রোবাংলা কিংবা মন্ত্রণালয় গ্যাস সংযোগ কিংবা লোডবৃদ্ধি করবে না। কোম্পানিগুলোর বোর্ডেই অনুমোদন দেবে। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে গ্রাহকের গ্যাস প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। কি পরিমাণ চাহিদা বাড়লে সে বিষয়টি মনিটরিং করা। যাতে সে অনুযায়ী এলএনজি আমদানি করা যায়।

এখনই আপনাদের ঘাটতি প্রায় ১৩০০ মিলিয়নের মতো, সে পরিমাণ আমদানি বাড়ানোর কোন সুযোগ নেই। তাহলেতো নীতিগতভাবে আর সংযোগ দেওয়ার কোন সুযোগ থাকে না। জবাবে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের দেশীয় উৎস থেকেও উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিতরণ কোম্পানিগুলোর ‍সুত্র জানা গেছে, মূলত মন্ত্রণালয়ে মধ্যমসারির কিছু কর্মকর্তা প্রতিনিয়ত তদ্বীর ব্যস্ত। অনেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শুরুর দিতে কাজ করে দিলেও এখন বোর্ডের দোহাই দিয়ে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এতেই ক্ষেপেছেন তদ্বীরবাজরা। তারা বোর্ডগুলোকে দেখে নেওয়ার হুমকি শুনিয়েছিলেন। নতুন আদেশের পেছনে ওই তদ্বীরবাজদের ভূমিকা থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও এই ক্ষমতার চর্চ্চা জারি রেখেছিল মন্ত্রণালয়। তারা উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে নে সংযোগ বাণিজ্য করতো। বিতরণ কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের কাগজের পুতুল বানিয়ে রাখা হয়েছিল। একজন গ্রাহক পুরাতন মেশিন বদলে নতুন মেশিন বসাবেন তার জন্যও মন্ত্রণালয়ে ধর্না দিতে হতো। যে মেশিনগুলো বদলে ফেললে একদিকে যেমন গ্রাহকের লাভ তেমনি সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতির কারলে রাষ্ট্রও লাভবান হতো। বছরের পর বছর ঝুলে রাখা হতো সেসব স্থাপনা পুনঃনিব্যাস কার‌্যক্রমও। এমনও দেখা গেলে নতুন মেশিন এনে ওয়ারেন্টির মেয়াদ পার হয়ে গেছে কিন্তু চালু করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

সরকার পরিবর্তনের পর সেই ধারায় কিছুটা ছেদ দেখা যায়। বিশেষ করে তিতাস বোর্ড ব্যবস্থাপনা পরিচালককে কিছু ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়। সময়ের ব্যবধানে মন্ত্রণালয় আবার জেকে বসতে শুরু করেছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলাদের মতোই সেই ধারা চালু হওয়ায় অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, তাহলে কিসের সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। এটাকেতো কুক্ষিগত ছাড়া কিছুই বলা যায় না।

শুধু তাই নয়, আগের সরকার যে প্রবিধানমালার দোহাই দিয়ে জ্বালানি তেলের দাম নির্বাহী আদেশে নির্ধারণ করতো। সেগুলো এখনও ঝূলে রাখার পাথেই হাটছে। পনের দিনে কাজ ৮ মাসেও শেষ করা যায় নি। ২০১২ সাল থেকে ঝুলে থাকা প্রবিধানমালা অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রথম দিকে নাড়াচাড়া শুরু হলেও এখন আবার অন্ধকারে চলে গেছে। আগের সরকারের আমলাদের মতোই বর্তমান আমলারাও বিষয়টি ঝুলে রাখার পথেই হাটছে। জ্বালানি উপদেষ্টা প্রথম দিকে যতটা সিরিয়াস ছিলেন এখন তার আগ্রহেও ভাটার টান দেখছেন কেউ কেউ। নতুন নির্দেশনার ফলে বিতরণ কোম্পানি তথা পেট্রোবাংলায় এক ধরনের স্থবিরতা নেমে আসবে।

ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, নির্বাহী আদেশে এই কাজগুলো করা সমিচীন হচ্ছে না। কর্তৃত্বগুলো স্বচ্ছ হওয়া দরকার। কোম্পানিগুলোর বোর্ড সংশ্লিষ্ট ও দক্ষ লোক দিয়ে গঠন করা দরকার। আমলাদের দ্বারা বোর্ড গঠন করা মুর্খতা ছাড়া আরও কিছুই না।

তিনি আরও বলেন, আইন অনুযায়ী সকল ধরণের জ্বালানির দাম নির্ধারণের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে বিইআরসির হাতে। মন্ত্রণালয় সম্পুর্ন বেআইনীভাবে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করে যাচ্ছে। আইনে রেগুলেশন তৈরির এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে বিইআরসিকে। সেখানে মতামত দেওয়ার কথা মন্ত্রণালয়ের। তারা মতামত না দিয়ে আটকে রেখে নিজেই তেলের দাম নির্ধারণ করে যাচ্ছে। আমরা শিগগিরই আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৬:৪৮ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫

দৈনিক গণবার্তা |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ

সম্পাদকঃ শাহিন হোসেন

সহকারী সম্পাদকঃ মোঃ শাহ পরান হাওলাদার

বিপিএল ভবন (৩য় তলা ) ৮৯, আরামবাগ, মতিঝিল, ঢাকা ।

মোবাইল : ০১৭১৫১১২৯৫৬ ।

ফোন: ০২-২২৪৪০০১৭৪ ।

ই-মেইল: ganobartabd@gmail.com