আজ, রবিবার


২৯শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ব্যাংকিং আইন সংস্কার: কার স্বার্থে, কোন উদ্দেশে?

শনিবার, ৩১ মে ২০২৫
ব্যাংকিং আইন সংস্কার: কার স্বার্থে, কোন উদ্দেশে?
সংবাদটি শেয়ার করুন....
স্টাফ রিপোর্টার:

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের উদ্যোগ জোরদার হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অর্ডিন্যান্সে’- সংশোধনী এনেছে। সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন নতুন করে বেশ কিছু ক্ষমতা অর্জন করেছে। সরকারিভাবে এই সংস্কারকে সুশাসন এবং জবাবদিহির হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠছে এ আইনের উদ্দেশ্য নিয়ে।

বৃহস্পতিবার (২৯ মে) নিউইর্য়ক গ্লোব পত্রিকায় এ নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

সংশোধিত আইনে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, শেয়ারহোল্ডারশিপ বাতিল, প্রশাসক নিয়োগ এবং জোরপূর্বক প্রতিষ্ঠানের কাঠামো বদলে দেওয়ার ক্ষমতা পেয়েছে।

এই আইন সংস্কারের নেপথ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি আইএমএফের একজন সাবেক অর্থনীতিবিদও।

‘ব্যাংক রেজল্যুশন অর্ডিন্যান্সে’- সংশোধনীকে এই খাতে চলা দীর্ঘদিনের অনিয়ম-দুর্নীতিকে দূর করে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করলেও সমালোচকরা বলছেন, এর মূল কাজ হলো রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের একটি পথ তৈরি করা।

ব্যাংকিং খাতের এই সংশোধনী আনার পর সরকার এখন ছয়টি বেসরকারি ব্যাংকের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে যাচ্ছে। অনেক পর্যবেক্ষক সরকারের এই উদ্যোগকে ‘বিপদ সংকেত’ হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবসায়ীদের সম্পদ জব্দের নীলনকশা তৈরি করেছে।

এই ধরনের প্রক্রিয়াকে রাশিয়ার ‘রেইডার্স্টভো’ কৌশলের সঙ্গে তুলনা করা হয়। যাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের ‘প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি’ বলা হয়ে থাকে। করপোরেটের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের জন্য সেখানে নানা কৌশলও গ্রহণ করা হয়। প্রয়োজন হলে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও করা হয়, যাতে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কেউ কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারেন। এর নিশ্চিত ফল হলো সম্পদের রাজনৈতিক হস্তান্তর, যার পোশাকি নাম হলো ‘সংস্কার’।

এই ক্ষেত্রে রুশ সরকারের দুটি কুখ্যাত ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। এর একটি ইউকশ তেল কোম্পানির ঘটনা। ক্রেমলিনের সঙ্গে বিরোধিতার কারণে ২০০০ সালের শুরুর দিকে এই কোম্পানির পতন ঘটে। কর ফাঁকিসহ নানা অভিযোগ দায়ের করা হয় এর মালিক মিখাইল খোদরকভস্কির বিরুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত মিখাইল দেউলিয়া ঘোষিত হন। তার সম্পদ বিক্রি করা হয়। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন রসনেফট ওই সম্পদ কিনে নেয়।

আরেকটি কোম্পানি হলো উইম-বিল-ড্যান। রাশিয়ার ডেইরি খাতের বড় কোম্পানি ছিল এটি। তবে তদারকি আইন ও আর্থিক বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কোম্পানির শেয়ার তুলে দেওয়া হয়েছিল পেপসিকোর হাতে।

তদারকি আইন নিয়ে বিভিন্ন দেশে ভিন্নতা থাকতে পারে। তবে এর সর্বশেষ লক্ষ্য একই। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ অথবা স্বাধীন শক্তির অর্থনৈতিক সক্ষমতা ভেঙে দিয়ে তার ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ গ্রহণই এর মূল লক্ষ্য। উদ্বেগের বিষয় হলো- ড. মনসুর সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, ছয়টি বেসরকারি ব্যাংককে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের আওতায় নেওয়া হবে। ব্যাংকগুলোকে ‘শক্তিশালী বিদেশি বিনিয়োগকারীদের’ হাতে তুলে দেওয়া হবে।

বাংলাদেশে এখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের মূল টার্গেট হলো এস আলম গ্রুপ। চট্টগ্রামভিত্তিক এই ব্যবসায়িক গোষ্ঠী ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মূল শেয়ারের মালিক। গত এক দশকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি স্টিল, বিদ্যুৎ, শিপিং ও আর্থিক খাতে তার পদচিহ্নের বিস্তার ঘটিয়েছে। অভিযোগ করা হয়ে থাকে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে এস আলম গ্রুপের সখ্য ছিল।

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার সহযোগীদের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য পরিবর্তন করেছেন। আর্থিক খাতের বিরাজমান সংকট নিরসনের পরিবর্তে তারা এখন এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছেন। তাদের লক্ষ্য হলো- বিগত সরকারের অনুগত ব্যবসায়ীদের কলিজায় হাত দেওয়া।

সরকারের ব্যাংকিং খাতে এই সংস্কারের মাধ্যমে যেসব ব্যবসায়িক এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধুই একটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের অন্তত ১০টি ব্যবসায়িক গ্রুপের বিরুদ্ধে সরকার এমন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করছে। গ্রুপগুলো হলো বসুন্ধরা গ্রুপ, বেক্সিমকো, সিটি গ্রুপ, স্কয়ার গ্রুপ, আনোয়ার গ্রুপ, পারটেক্স গ্রুপ, একে খান গ্রুপ, যমুনা গ্রুপ, প্রাণ আরএফএল ও নাভানা গ্রুপ। সরকার এসব প্রতিষ্ঠানের তদারকি বাড়িয়েছে। তাদের অডিট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। তাদের সম্পদের উৎস খুঁজে বেড়াচ্ছে।

এ ধরনের ‘সংস্কার’ শুধুমাত্র আইন দিয়ে চালানো হলে তা রেগুলেটরি সিস্টেমের নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যদি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিচয়ধারী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকেই বারবার লক্ষ্যবস্তু করা হয়, তাহলে বিনিয়োগকারী মহলে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়। বিশেষ করে পারস্য উপসাগীয় অঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর বিনিয়োগকারীরা প্রশ্ন তুলবেন, বাংলাদেশে বেসরকারি বিনিয়োগ কি নিরাপদ, বিশেষ করে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে।

শরিয়াহভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপও বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। এ খাতে দীর্ঘমেয়াদি আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে আমানত সংগ্রহ করা হয়। কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হস্তক্ষেপ এই খাতে ব্যাপক আস্থাহীনতা সৃষ্টি করতে পারে, যার প্রভাব পড়বে সামগ্রিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর।

তত্ত্বগতভাবে, ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আইনগত সংস্কার প্রয়োজনীয় হতে পারে। কিন্তু সেই আইন প্রয়োগের পদ্ধতি ও লক্ষ্য যদি একপাক্ষিক হয়, তাহলে তা সংস্কার নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়।

এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক- বিগত সরকারের অনুগত ব্যবসায়ীদের সম্পদ জব্দ করে, প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিয়ে, ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে এনে যদি ‘সংস্কার’ বাস্তবায়িত হয়, তবে তা কার স্বার্থে? ব্যাংকিং সংস্কার যদি প্রয়োজন হয়, তবে সেটি হওয়া উচিত স্বচ্ছ, নিয়মতান্ত্রিক ও পক্ষপাতমুক্ত এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৮:০১ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ৩১ মে ২০২৫

দৈনিক গণবার্তা |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

আর্কাইভ

সম্পাদকঃ শাহিন হোসেন

সহকারী সম্পাদকঃ মোঃ শাহ পরান হাওলাদার

বিপিএল ভবন (৩য় তলা ) ৮৯, আরামবাগ, মতিঝিল, ঢাকা ।

মোবাইল : ০১৭১৫১১২৯৫৬ ।

ফোন: ০২-২২৪৪০০১৭৪ ।

ই-মেইল: ganobartabd@gmail.com