মেঘনা গ্রুপের বকেয়া গ্যাস বিল ৮৬২ কোটি টাকা আদায়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। মেঘনা সুগার রিফাইনারী লিমিটেডের সংযোগ আগে বিচ্ছিন্ন হতে পারে তিতাস গ্যাস সূত্র নিশ্চিত করেছে।
তিতাস গ্যাসের একজন পদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছে, ইতোমধ্যেই বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড.ফাওজুল কবির খান বকেয়া বিল আদায়ের বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। গত ১৬ এপ্রিল এক সভায় সিস্টেম লস হ্রাস সংক্রান্ত এক সভায় বকেয়া ফেলে রাখা সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, বকেয়া আদায়ের জোর পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা রয়েছে। যাদের বকেয়া রয়েছে তাদের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। শিগগিরই আপনারা ফলাফল দেখতে পারেন।
তিতাস গ্যাস সূত্র জানিয়েছে, মেঘনা গ্রুপের মতো কোম্পানিগুলো তিতাসকে ব্ল্যাকমেইল করে যাচ্ছে। গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে যাবে। সে বিষয়টিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। ব্যাংক ঋণ নিলে সুদ দিতে হবে, তা না করে গ্যাস বিলকে মূলধন বানিয়ে ফেলেছে তারা। লাইন কাটতে গেলে নানা রকম চাপ প্রয়োগ করে থাকে। কখনও কখনও শ্রমিকদের লেলিয়ে দেয় আমাদের ওপর। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে।
আবার কোনো কর্মকর্তা শক্ত অবস্থান নিতে গেলে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। কোটি কোটি টাকা ঢেলে তাদের পদ-বদলি করে ছাড়ে। তাই অনেকেই তাদের ঘাটাতে চায় না। আর চায় না বলেই বছরের পর বছর ধরে গ্যাস বিল আটকে রাখতে সক্ষম হয়। ক্ষেত্র বিশেষে অনেক কর্মকর্তাও কমিশন হাতিয়ে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। তারাই বুদ্ধি শিখিয়ে দেন কিভাবে গ্যাস বিল আটকে রাখা যাবে। কেউ কেউতো ঠুনকো অজুহাতে মামলা দিয়ে বকেয়া আদায়ের বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছেন বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা।
মেঘনা গ্রুপের দু’টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ৮৬২ কোটি টাকা গ্যাস বিল বকেয়া পড়েছে তিতাস গ্যাসের। বছরের পর বছর বকেয়া ফেলে রাখলেও আওয়ামী সরকারের ঘনিষ্ঠতার কারণে কেউ ঘাটাতে সাহস পাননি এতোদিন। যখনই কোনো কর্মকর্তা বিল আদায়ে শক্ত অবস্থান নিতে গেছেন উল্টো তাকেই চেয়ার হারাতে হয়েছে। সাবেক একজন এমডির ছেলেকে বিপুল পরিমাণ বেতন দিয়ে চাকরি দিয়েছিল মেঘনা গ্রুপ। যার বিনিময়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছিলেন ওই এমডি। আর এসব সুযোগে বকেয়া গ্যাস বিলকে মূলধন বানিয়ে ফেলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিটি।
তিতাস গ্যাস সূত্র জানিয়েছে, মেঘনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এভারেস্ট পাওয়ার লিমিটেডের কাছে বকেয়া পড়েছে ৭৭০ কোটি টাকা। আর মেঘনা সুগার রিফাইনারির বকেয়ার পরিমাণ ৯২ কোটি টাকা। দফায় দফায় চিঠি দিয়েও বকেয়া উদ্ধার করতে পারছে না তিতাস। এভারেস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (ক্যাপটিভ) হিসাবে ২০১০ সালে চালু হয়। কোম্পানিটির গ্যাস সংযোগ অনুমোদনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপ ছিল ওপেন সিক্রেট বিষয়। ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সরেজমিন গিয়ে উদ্বোধন করেছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। যা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কর্মকর্তাদের কাছে ছিল বিস্ময়ের। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ওই দহরম-মহরমের কারণে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মেঘনা গ্রুপের কর্ণধার মোস্তফা কামালকে। যা খুশি তাই করে গেছেন। চুক্তির মাঝপথে এসে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতাও বাড়িয়ে নিয়েছেন।
শুরুতে কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ মেগাওয়াট থাকলেও ৩ বছর পরে ২০১৪ সালে ৫০ দশমিক ৭০ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হয়। একইসঙ্গে ক্যাপটিভ থেকে স্মল আইপিপি হিসেবে রূপান্তরিত হয়ে যায় এভারেস্ট পাওয়ার। কেন্দ্রটির উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও মেঘনা ইকোনমিক জোনে অবস্থিত বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে থাকে। বিইআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে দেওয়া বিদ্যুতের গ্যাসের বিল আইপিপি রেটে এবং বাইরে বিক্রি করা বিদ্যুতের অংশের গ্যাসের দাম ক্যাপটিভ রেটে পরিশোধ করার কথা। কিন্তু বিইআরসির নির্দেশনা অমান্য করে ক্যাপটিভ রেটে গ্যাস বিল প্রদান থেকে বিরত রয়েছে কোম্পানিটি।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, মেঘনা গ্রুপের বকেয়ার বিষয়টি সমাধান হওয়া দরকার। এরকম একটি কোম্পানির বিল আদায় না হওয়া খুবই দুঃখজনক। তারা বিভিন্ন সময় নানা প্রেসার গ্রুপ ব্যবহার করে পার পেয়েছে। এর ফলে বিপুল পরিমাণ বকেয়ার কারণে তিতাস গ্যাস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা এখন হার্ডলাইনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
মেঘনা গ্রুপ আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠতাকে পুঁজি করে ‘নয়কে ছয়’ করে গেছে। ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন পণ্য সিন্ডিকেট করে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও সরকার ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। আন্ডার ইনভয়েসিং, ভ্যাট ফাঁকি, টাকা পাচারের অভিযোগ উঠেছে গ্রুপটির কর্ণধার মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে। ৮০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত দল গঠন করেছে। গত ৮ এপ্রিল একটি পত্র জারি করে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করার নির্দেশ দেয় দুদক।
অন্যদিকে, মোস্তফা কামাল, তার স্ত্রী বিউটি আক্তার ও সন্তানদের ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করার খবর পাওয়া গেছে। গত ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। পাশাপাশি তাদের একক নামে পরিচালিত কোনো প্রতিষ্ঠান থাকলে তার হিসাবও জব্দ করতে বলা হয়েছে।
বিল খেলাপির পাশাপাশি বিশাল অঙ্কের ব্যাংক ঋণের তথ্য পাওয়া গেছে মেঘনা গ্রুপের বিরুদ্ধে। গ্রুপটির ৫৫টি প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ১৬ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বিল খেলাপির তালিকায় থাকা মেঘনা সুগার রিফাইনারির নামে ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছেন ৩ হাজার ১৮ কোটি টাকা। গোয়েন্দা বিভাগ মনে করছে, এর বেশিরভাগ অর্থই নানাভাবে বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
Posted ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫
দৈনিক গণবার্তা | Gano Barta