বিশেষ প্রতিবেদন : ভ্রমণপিয়াসীদের মাঝে ‘আতঙ্কের অনুষঙ্গ’ হয়ে উঠছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের ঢেউ। নীল জলরাশির উপচে পড়া ঢেউ দেখে উচ্ছ্বাসে নিয়ম ভেঙে যেখানে-সেখানে গোসলে নামায় দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। সৈকতে অবকাঠামোগত নানা উন্নয়ন হলেও নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থা না হওয়ায় হতাশ পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। কোরবানির ঈদে বাবা-ছেলেসহ ছয়জনের মৃত্যুর মাস না পেরোতেই মঙ্গলবার (৮ জুলাই) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী হিমছড়ি সৈকতে গোসলে নেমে স্রোতে ভেসে যান। তাৎক্ষণিক একজন এবং ২৪ ঘণ্টার মাথায় বুধবার সকালে আরেকজনের মরদেহ উদ্ধার হলেও বাকিজনের হদিস মেলেনি আজও। কোরবানির ছুটিতে ১২ জুন দুপুরে ভেসে যাওয়া দুই পর্যটককে বিপদাপন্ন অবস্থায় উদ্ধার করে সময় মতো হাসপাতালে নিতে পারায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরেন তারা। শত কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতে ঢেউয়ে একাধিক স্থানে ভাঙন ও গুপ্তখালের সৃষ্টি হওয়ায় পানিতে নামার আগে বিপদ টের পাচ্ছেন না পর্যটকেরা। আর বিপদাপন্ন হলে উদ্ধারের আয়োজনও অপ্রতুল। ফলে নোনাজলের ছোঁয়া নিতে যাওয়া পর্যটকদের মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না।সৈকতে গোসলে নেমে পর্যটক মারা গেলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও নেই। মরদেহ পৌঁছাতেও টাকা খরচ হয় পর্যটকের। অথচ সৈকতের কিটকট চেয়ার, বিচ বাইক, ঘোড়া, দোকানপাটসহ নানা ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বাধীন বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি প্রতি অর্থবছরে মোটা অঙ্কের টাকা পেয়ে থাকে।
কক্সবাজার ট্যুরিস্ট ক্লাব ও টুয়াক সভাপতি মো. রেজাউল করিম বলেন, কোরবানির ঈদ ও পরবর্তী সাপ্তাহিক এবং নানা বন্ধ মিলিয়ে কক্সবাজারে লাখ লাখ পর্যটক বেড়াতে আসে। বর্ষাতেও তুলনামূলক পর্যটক উপস্থিতি রয়েছে। ভ্রমণে আসাদের মাঝে ৮০-৯০ শতাংশ পর্যটক সাগরের জলে গোসল করেন। কিন্তু গত তিন দশকেও সমুদ্রের নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। পর্যটন খাত থেকে হোটেল-মোটেল মালিক এবং সরকার বিপুল আয় করলেও নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সবাই উদাসীন। তিনি বলেন, ১২০ কিলোমিটার সৈকতের কলাতলী থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত মাত্র ৫ কিলোমিটারে উদ্ধার তৎপরতা চালানো জন্য বেসরকারি সি-সেইফ লাইফগার্ড নামের একটি সংস্থার ২৬ কর্মী রয়েছে। অবশিষ্ট ১১৫ কিলোমিটার অরক্ষিত বলা যায়। বিশেষ করে ইনানী, হিমছড়ি, দরিয়ানগর, টেকনাফ, বাহারছড়া, পাটুয়ারটেক পয়েন্টে কেউ গোসলে নেমে নিখোঁজ হলে উদ্ধার তৎপরতা চালানো তৎক্ষণাৎ হয়ে ওঠে না। ভ্রমণে আসাদের মাঝে ৮০-৯০ শতাংশ পর্যটক সাগরের জলে গোসল করেন। কিন্তু গত তিন দশকেও সমুদ্রের নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। পর্যটন খাত থেকে হোটেল-মোটেল মালিক এবং সরকার বিপুল আয় করলেও নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সবাই উদাসীন। ট্যুরিস্ট পুলিশ সূত্র জানায়, মঙ্গলবার (৮ জুলাই) সকালে কক্সবাজারের হিমছড়ি সমুদ্র সৈকতে পানিতে নেমে নিখোঁজ হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের তিন শিক্ষার্থী কে এম সাদমান রহমান সাবাব, অরিত্র হাসান ও আসিফ আহমেদ। এর মাঝে নিখোঁজের কয়েক ঘণ্টা পর সাবাবের মরদেহ উদ্ধার হয়। নিখোঁজ ছিলেন বাকি দুজন। বুধবার সকালে আসিফের মরদেহ ভেসে ওঠে। এখনো নিখোঁজ অরিত্র হাসান। তাদের সঙ্গে থাকলেও পানিতে না নামায় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যান আরও দুই সহপাঠী ফারহান ও রিয়াদ। সাবাবের মরদেহ মঙ্গলবার রাতেই পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তার বাড়ি ঢাকার মিরপুরে। আসিফ ও অরিত্র দুজনেই বগুড়ার সন্তান। সহপাঠী ফারহান বলেন, শুরুতে কারোরই বিচে নামার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু সাবাব নেমে পড়লে তার দেখাদেখি আসিফ, অরিত্রও নেমে যায়। শুরুতে ঢেউ বেশি ছিল না, কিন্তু হঠাৎ বড় ঢেউ আসতে শুরু করলে তারা উঠে আসার চেষ্টা করে কিন্তু পারেনি। চবির সহকারী প্রক্টর সাঈদ বিন কামাল চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, মঙ্গলবার সাবাবের মরদেহ উদ্ধারের পর পরিবারের কাছে পাঠানো হয়েছে। বুধবার সকালে আসিফের মরদেহ ভেসে এসেছে। তার মরদেহও সন্ধ্যার পরিবারকে হস্তান্তর করা হয়, কিন্তু অরিত্রকে বুধবারও খুঁজে পাওয়া যায়নি আনন্দ উচ্ছ্বাসে বিধিনিষেধ মেনে চলেন না অনেকে। একসঙ্গে হাজার হাজার পর্যটককে সামাল দিতে ২০-২৫ জন লাইফগার্ড, ১৫-২০ জন বিচকর্মী ও অর্ধশতাধিক টুরিস্ট পুলিশের হিমশিম খেতে হয়।সি-সেইফ লাইফগার্ডের সিনিয়র কর্মী মোহাম্মদ ওসমান বলেন, টানাবর্ষণে ও পাহাড়ি ঢলে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টের বালিয়াড়িতে নদীর মতো বিভাজন ও গুপ্তখালের সৃষ্টি হয়। এমন এলাকায় গোসলে নামতে নিষেধ করা থাকে, পাশাপাশি মাইকিংও করা হয়। কিন্তু আনন্দ উচ্ছ্বাসে বিধিনিষেধ মেনে চলেন না অনেকে। একসঙ্গে হাজার হাজার পর্যটককে সামাল দিতে ২০-২৫ জন লাইফগার্ড, ১৫-২০ জন বিচকর্মী ও অর্ধশতাধিক টুরিস্ট পুলিশের হিমশিম খেতে হয়। সি-সেইফ প্রতিষ্ঠানের তথ্য মতে, স্রোতের টানে ভেসে গত বছর আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে মারা গেছেন পাঁচজন পর্যটক। এর আগের ৬ বছরে ভেসে গিয়ে মারা গেছেন ৪৯ পর্যটক। সদ্যগত কোরবানির ঈদে কলাতলী সৈকতে গোসলে নেমে রাজশাহীর শাহিনুর রহমান (৫৮) ও সিফাত রহমান (২০) নামের পর্যটক বাবা-ছেলের মৃত্যু হয়। তারাসহ এ সময় সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ৬ জনের মৃত্যু হয়। এদের মাঝে তিনজন পর্যটক, একজন স্থানীয়। অপর দুজনের পরিচয় শনাক্ত হয়নি। পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক সংগঠন ‘সেইফ কক্সবাজার’র চেয়ারম্যান তৌহিদ বেলাল বলেন, সৈকততীরে এলে সমুদ্রের ঢেউ পর্যটককে আকর্ষিত করে। নানা বয়সী পর্যটকরা নোনাজলের সান্নিধ্য নেয়। সাগরতীর ঘিরে কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে পর্যটন জোনে। কিন্তু কয়েক লাখ টাকা খরচ করে সমুদ্রের পানিতে সি-নেটিং সিস্টেম গড়ে তুলে পর্যটকের নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থায় কেউ আগ্রহী বলে মনে হয় না। সৈকতে গোসলে নেমে পর্যটক মারা গেলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও নেই। মরদেহ পৌঁছাতেও টাকা খরচ হয় পর্যটকের। অথচ সৈকতের কিটকট চেয়ার, বিচ বাইক, ঘোড়া, দোকানপাটসহ নানা ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বাধীন বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি প্রতি অর্থবছরে মোটা অঙ্কের টাকা পেয়ে থাকে। তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইস লিমিটিডের পরিচালক আবদুল কাদের মিশু বলেন, হোটেলে আসা অতিথিদের সমুদ্রে গোসলসহ নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়ে সচেতন করা হয়। তারপরও অনেকে নির্দেশনা অমান্য করে ঝুঁকিপূর্ণ সৈকতে নেমে বিপদের সম্মুখীন হচ্ছেন। তাতে হোটেল মালিকরাও বিব্রত। এ তথ্য পর্যটনের জন্য শোভনীয় নয়। ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিয়ন প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, বৈরী আবহাওয়ায় সাগর বেশ উত্তাল। বড় ঢেউয়ে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে বেলাভূমি গুপ্তখালে রূপ নেয় বলে জেনেছি। এসব এলাকায় না নামতে সতর্কতামূলক লাল নিশানা ওড়ানো থাকে। কিন্তু নির্দেশনা অমান্য করে বা না বুঝে এসব এলাকায় গোসলে নামলে পর্যটকরা স্রোতের টানে পড়ে বিপদাপন্ন হন। ফলে আনন্দ ভ্রমণটা অনেক পর্যটকের পরিবারে বিষাদে রূপ নিচ্ছে। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে দীর্ঘ হচ্ছে মৃতের মিছিল। কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) ও বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির তত্ত্বাবধায়ক মো. শাহিদুল আলম বলেন, জেনেছি একযুগ আগে লাবণী পয়েন্টের জাল দিয়ে ঘিরে পর্যটকের নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থা গড়া হয়েছিল। কয়েক মাসের মাথায় ঢেউয়ের ধাক্কায় তা বিলীন হয়। গত কয়েক বছর ধরে বেলাভূমিতে ভাঙন তীব্র হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কোথায় নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়, তা নিয়ে গবেষণা দরকার। এরপরও সাগরে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু রুখতে মাইকিংসহ নানাভাবে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ চলমান রয়েছে।
Posted ৯:৪৯ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫
দৈনিক গণবার্তা | Gano Barta