আলমগীর হোসেন সুমন : আমরা যারা স্বাধীনতার পরে জন্ম নিয়েছি তারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬৬ ছয়দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০এর সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭১এর মহান মুক্তিযুদ্ধে শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে সফলতা কিংবা স্বাধীনতা পরবর্তী যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশকে বিনির্মানের আত্ননিয়োগে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট ইতিহাসের জঘন্যতম নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখিনি। ইতিহাসের ধারক, বাহক ও ঘাতকদের নির্মমতার শিকার প্রত্যক্ষদর্শী শহীদ জননী শাহানারা বেগম এর মুখে শুনেছিলাম ইতিহাসের জীবন্ত কথাগুলো আর ফিরে গিয়েছিলাম ইতিহাসের সেই দিনগুলোতে।
৩১ আগস্ট, ২০১৯। বরিশার জেলা প্রশাসন আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠান। বরিশারের ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু উদ্যানে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। তখনও জানতাম না কী শুনতে যাচ্ছি। নির্মম নিষ্ঠুরতার শিকার প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের হৃদয় বিদারক কথা শুনবো ভাবিনি। কিন্তু শুনলাম বুলেট বিদ্ধ চোখের সামনে সন্তান-স্বজনহারা মায়ের মুখে ঘাতকদের নির্মমতার বর্ণনা। ইতিহাসের হৃদয় বিদারক কথা শুনে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। শুধু আমিই নই, সেদিন কেঁদেছিলেন বেগম শাহানারা আব্দুল্লাহ, কাঁদিয়ে ছিলেন উপস্থিত সবাইকে।
১৫ আগস্টের নির্মমর্তা অনেকের মুখে অনেক ভাবে শুনেছি। কিন্তু ইতিহাসের কথাগুলোকে শাহানারা আব্দুল্লাহর মতে জীবন্ত ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেননি কেউ। ২০২১ সালেও অনেকে ১৫ আগস্টের নির্মমতা বর্ণনা করেছেন। আমার কানে শোনা শাহানারা আব্দুল্লাহর কথাগুলো এখনো বেজে ওঠে এবং মনে হয় চোখের সামনে নির্মম দিনগুলো ভেসে ওঠে।
আমরা নবীন প্রজন্ম স্বাধীনতা যুদ্ধের গণহত্যা কিংবা ৭৫ এর নির্মমতা দেখিনি। ওই সময়ের কথাগুলো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে শুনে ছিলাম, পাঠ্য বইতে সংক্ষিপ্ত আকরে পেয়েছিলাম। কোনো কোনো শাসনামলে হয়তো প্রকৃত ইতিহাসকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। আমরা কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকে সামনে বসে কখনো শুনতে পারিনি। কিন্তু ৩১ আগস্ট ২০১৯ মমতাময়ী, সন্তান ও স্বজনহারা মা শাহানারা বেগমের মুখে শুনলাম ৭৫এ ঘটে যাওয়া ইতিহাসের জঘন্যতম নির্মম হত্যাকাণ্ডের হৃদয় বিদারক কথা।
তাঁর কথাগুলো শোনার সাথে সাথে চোখের সামনে ভেসে উঠেছিলো নির্মমতার দৃশ্যগুলো। মনে হয়েছিলো ফিরে গেছি ৭৫’র ১৫ আগস্ট। সেদিন নির্মমতার শিকার হয়েছিলেন তার পরিবারের লোকজন। জীবন ছিলো তাদের অনিশ্চিত। সেই অনিশ্চিত জীবনের স্মৃতিচারণ করেন তিনি। স্মৃতিচারণের সময় অনুষ্ঠানস্থলে নেমে এসেছিলো পিনপতন স্তব্ধতা।
শাহানারা বেগম ছিলেন একজন বিচক্ষণ ও সাহসী নারী। চোখের সামনে সন্তান-স্বজন হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। সেই শোক বয়ে বেরিয়েছেন আমৃত্যু। নিজের চোখের সামনে একে একে সন্তান ও স্বজনদের হারিয়ে ঘাতকদের বুলেটের আঘাত সহ্য করেও বেঁচে ছিলেন সেদিন। আর তিনি বেঁচে ছিলেন বলেনই আমরা শুনতে পেয়েছিলাম, বুঝতে পেরেছিলাম উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম সেই দিনের নির্মমতার বর্ণনা। ঘাতকদের নির্মমতার কথা শুনে কান্না পেয়েছিলো তবুও সেদিন শুনতে ইচ্ছে করছিলো। অজানাকে জানা এবং ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকে কথাগুলো এভাবে শোনার ভাগ্য ইতিপূর্বে হয়নি। তাই আগ্রহটা ছিলো আরও বেশি।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ঘাতকরা চেয়েছিলেন ইতিহাস থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব ও তার পরিববর্গ, কৃষক কূলের নয়নের মনি শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে বিনাশ করে দেশকে পিছিয়ে ফেলতে। সত্য আর ন্যায়কে কখনও বিনাশ করা যায়না। যারা ইতিহাসকে মুছে ফেলতে চেয়েছিলো তারাই ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
৭৫’র ১৫ আগস্টের পরে মমতাময়ী মা শাহানারা বেগম সন্তান স্বজনহারা শতকষ্ট নিয়েও রাজনীতির মাঠ ছাড়েননি। জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি পর্বত্য শান্তিচুক্তি পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক (মন্ত্রী), দক্ষিণ বাংলার রাজনৈতিক অভিভাবক, বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপির পাশে থেকে সাহস যুগিয়েছেন, শক্তি ও প্রেরণা দিয়েছেন। শাহানারা বেগমের অনুপ্রেরণায় আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ রাজনৈতিক আসনের অনন্য উচ্চতায় আসীন হতে সক্ষম হয়েছেন। সাথে সাথে তিনি তার সন্তানদের রাজনীতির মাঠে শতপ্রতিকূলতার মাঝে সাহসী ও যোগ্য করে তুলেছেন। মা শাহানারা বেগমের অনুপ্রেরণা ও অনুকরনে তার সন্তানেরা রাজনীতির মাঠে সফলতার সাথে এগিয়ে চলেছেন।
শাহানারা বেগম একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সফল নারী সংগঠক, প্রাণবন্ত একজন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছিলেন। শাহানারা বেগম ছিলেন দক্ষিণবঙ্গের স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের শেষ ভরসাস্থল। তিনি ছিলেন মমতাময়ী মা, ছিলেন একজন মহিয়সী নারী।
বাংলাদেশ ও জাতির পিতা এক ও অবিচ্ছিন্ন। ইতিহাসে চিরস্মরণীয় মহান মুক্তিযুদ্ধকে যেমন জানা প্রয়োজন তেমনী প্রয়োজন ১৫ আগস্টের নির্মমতাকে উপলদ্ধি করা। দেশ বিনির্মানে যারা আত্নত্যাগ করেছেন তাদেরই হত্যা করা হয়েছে ১৫ আগস্টের কালো রাতে। সেই নির্মমতার ইতিহাস প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখ থেকে শুনতে পারা এবং তা অন্তরে ধারণ করে জাতীয় শোককে শক্তিতে পরিণত করে দেশ ও জাতি গঠনে আত্ননিয়োগ করার এখনই সময়। সময়ের আবর্তে আমরা ইতিহাসের ধারক ও বাহকদের হারাচ্ছি।
২০২০ সালের ৭জুন এই মমতাময়ী মা মহিয়সী নারী শাহানারা আব্দুল্লাহকে হারিয়েছি আমরা। হারিয়েছি আমাদের অভিভাবককে। শোকাবহ আগস্ট চলে যায়। কিন্তু জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে আর কোনো দিন শুনতে পাব না সন্তান ও স্বজনহারা বুলেট বিদ্ধ মায়ের মুখে ১৫ আগস্টের নির্মমতার কথা। প্রতিবছর ১৫ আগস্টে জাতীয় শোক দিবসে থাকবো আমরা। কিন্তু মায়ের আসা এবং বক্তব্যের অপেক্ষা করা হবে না আমাদের।
লেখক : সভাপতি, মুলাদী প্রেসক্লাব, মুলাদী, বরিশাল।