করোনার হানায় বাংলাদেশসহ বিশ্ব অর্থনীতিতে হিমশিম খাওয়া অবস্থায় জীবন-জীবিকার সমন্বয় আনতে দেশে ঘোষিত হলো ২০২০-২১ সালের বাজেট। আকারে বিশাল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করা হলেও অর্থমন্ত্রীকে বিশাল বক্তৃতা করতে হয়নি। করোনার কারণে স্বাধীনতার ৫০ বছরে ৪৯তম বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে সীমিত পরিসরে,স্বল্পসংখ্যক সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে। বাজেটে বিশালত্বের মাধ্যমে বিশ্বকে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে এই মহামারির সময়েও ৮ এর ওপর প্রবৃদ্ধি রাখতে পেরেছে বাংলাদেশ।
বছর দশেক আগেও অবস্থাটা এমন ছিল না। বাজেট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উত্তেজনার যে অবশিষ্ট ছিল এখন তার ছিঁটাফোটাও নেই। এটা এখন কিছু নির্দিষ্ট মাথাওয়ালাদের বিষয় হয়ে গেছে। এর নেপথ্য ট্র্যাজেডি হচ্ছে,বাজেট বিষয়ে বর্তমান সংসদের সরকারি দল আর বিরোধীদলের মন-মনন কাছাকাছিই। প্রায় অভিন্ন কৌশল তাদের। বিরোধীদল ধরেই নেয়, সরকার তাদের কেয়ার করে না। তাদের মতামত নেওয়ার নূন্যতম গরজ বোধ করে না। আসল কথা হচ্ছে বাজেট প্রনয়ণ ও পাস দু’টাই একটি বিজনেস কমিউনিটির আয়ত্বে। তারাই সরকার। তারাই ব্যাবসায়ী। জনগন সেটাকে ললাটের লিখন বলে মেনে নিতে বাধ্য এবং অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাদের মূল আগ্রহ থাকে বাজেটে তাদের জীবন বাঁচানো আর জীবিকা রক্ষার কোনো সুরাহা হবে কি না। গত অর্থবছরের তুলনায় এবার ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বাজেট ঘোষিত হলেও সে অনুযায়ী কৃষি, স্বাস্থ্য, জন-সুরক্ষা, শিক্ষা, গবেষণা, কর্মসংস্থান খাতে তেমন উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ বাড়েনি। দেশের এবং বিশ্ব অর্থনীতির বাস্তবতাকে বিবেচনায় না নিয়ে প্রবৃদ্ধি বেশি দেখানোর প্রবণতা বাজেটের বাস্তবায়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দেশে উচ্চবিত্ত ও নব্যধনী মানুষের উত্থান আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। তারা বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন বেশি, পানিও তারা বেশি ব্যবহার করেন, রাস্তাঘাটে তারাই গাড়ি চালান, অর্থাৎ জনগণের করের টাকায় এবং শ্রমে যা কিছু উৎপাদিত হয় তার বেশি ব্যবহারের সুবিধা তারাই পান।
পুঁথিগতভাবে বাজেটের ফিসক্যাল পলিসি ক্লাস নাইন-টেনের অর্থনীতির শিক্ষার্থীরাও জানে। কিন্তু, বাস্তবে বাজেট কেবল সরকারের আয়- ব্যয়ের হিসাব নয়। এটি ধারণকৃত ফিসক্যাল পলিসির বিপরীতে ক্ষমতায় থাকা দলটির রাজনৈতিক আদর্শের প্রতিফলন। আর নিষ্ঠুর সত্য হচ্ছে, স্বাধীনতার পর প্রথম কয়েক বছর বাদ দিলে- বিগত ৪৫ বছরের কোনো ক্ষমতাসীন দলেরই সত্যিকারের রাজনৈতিক আদর্শ ছিল না। সবার একই আদর্শ ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতা ধরে রাখা। এতে কেউ বেশি সফল। কেউ কম। ক্ষমতার উদ্দেশ্য সাধনে তারা নিজেদের সুবিধা মতো এডহক বাজেট কার্যকর করে আসছেন। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। বরাবরের মতো এ বাজেট বিশ্লেষণেও দেখা যায় ব্যাপক অংকের রাজস্ব আদায়ের টার্গেট। আর সরকারের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতার বাইরের রাজস্ব আর উন্নয়ন ব্যয়ের নামে-সেই টাকার সিংহভাগ অপচয়। দুর্নীতি-পাচারের সুযোগও পরতে পরতে। আর বেশি না বুঝে আরেক মহলের সোজা বুঝ হচ্ছে, বাজেট মানে মানুষের উপর করের বোঝা। দেশের উপর ঋণের বোঝা চাপিয়ে বছর বছর রাজপুন্যাহ।তাই বাজেট বড় হলে ভয়ও বাড়ে। সত্যজিত রায়ের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘ভর পেট নাহি খাই, রাজ কর দেয়া চাই’-এর মতো দশা মানুষের।
স্বাস্থ্যে বাজেট বাড়ার সুখবর দুঃসংবাদে পরিণত হতে বিলম্ব হয়নি। আবার স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটার মহাদুর্নীতির নতুন নতুন চিত্রও বেরিয়ে আসছে। প্রকাশ্য বিষয়ে যে মিথ্যাচার এ মন্ত্রণালয় কোভিড নিয়ে করেছে তাতে জনগণের আশংকা এই চক্র সামনে আরো বেপরোয়া ও লাগামহীন হবে। বিড়াল না সরিয়ে রান্নাঘরে মাছের সরবরাহ বাড়িয়ে সেই পথই করা হয়েছে। কারোই জানার বাকি নেই যে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বাড়তি কামাইয়ের জায়গা। এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর চাঁদ কপাল। করোনার পরে দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল,স্বাস্থসেবা খাতে বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ অনেক বাড়ানো হবে।আশানুরূপ না বাড়লেও আগের বছরের চেয়ে প্রায় ২০% বেড়েছে। এছাড়া কোভিড-১৯ এর জন্য জরুরি প্রয়োজন মেটাতে দশ হাজার কোটি টাকার একটা জরুরী ফান্ড রাখা হয়েছে। সমস্যা আসলে অন্য জায়গায়। সেই সমস্যা হলো-স্বাস্থ্যসেবা খাতে অপচয় দুর্নীতি।
হাসপাতালগুলোতে আগের সরঞ্জাম খরিদের দুর্নীতির বিষয় শেষ না হতেই এলো পিপিই,মাস্কসহ সরঞ্জাম খরিদে অনিয়ম আর দুর্নীতির খবর। সেইটার রেশ কাটতে না কাটতেই,দেশের মানুষ অবাক হয়ে জানলো স্বাস্থ্যসেবার জন্য ডাটাবেজ তৈরিতে পুকুর চুরির খবর। তারা বুঝতে অক্ষম এই করোনা কালে মানুষ যেখানে চিকিৎসা না পেয়ে দিশেহারা, সেখানে এই বিভাগের লোকজন একের পর এক এহেন অপকর্ম কিভাবে করে যেতে পারছে? স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ পাঁচগুণ বাড়ানো হলেই বা কী। কার লাভ? জনগণের নয়। লাভ হল লুটেরা ঠিকেদার, দুর্নীতিবাজ কিছু রাজনীতিক, আমলা আর স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজনের। ডাক্তারদের বেতন বাড়িয়ে মাসে দু লাখ টাকা করলেও কেউ গ্রাম তো দূরের কথা উপজেলায়ও যাবে না। কিছু অসাধু ডাক্তার সরকারি চাকরি করে রোগী বাগানোর জন্য। এজন্য মাইনে করা দালাল আছে। আবার ধরা যাক, শিক্ষাখাতে বররাদ্দ বাজেটের ৪০ ভাগ করা হল। কী হবে? শিক্ষকরা নিজেদের পেশাগত মানোন্নয়নে সচেষ্ট হবেন না। তারা কাজে ফাঁকি দেবেন, কোচিং করবেন। স্বাস্থ্যসহ যে কোনো খাতেই বরাদ্দ বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে লুটপাট, দুর্নীতি, অপচয় বাড়ে। জনগণের পকেট কাটা যায় আরও বেশি করে। সুশাসন, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা না থাকায় বাজেট আপনাআপনিই লুটপাটের আইনি দলিল হয়ে যায়। আসল সমস্যা হচ্ছে নৈতিকতার প্রবল সংকট।
এবারের বাজেটে আগের বছরের প্রকৃত আদায়ের চেয়ে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৫০% বাড়ানো হয়েছে,যা জনগনের কাছ থেকেই আদায় করা হবে। এই করের মধ্যে বেশীরভাগ আবার পরোক্ষ কর যা, আমজনতাই দিয়ে থাকে। অন্যদিকে, অপ্রদর্শিত অর্থ ব্যাংকে নগদে, এফডিআর’এ, বিভিন্ন সঞয়ী স্কিমে ১০% কর পরিশোধে বিনিয়োগের সুযোগের প্রস্তাব রাখা হয়েছে! এর আগে কখনো এমন প্রস্তাব করা হয়নি। একটা ছোট প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে। তা হলো- এবছর রিলিফের চাল, তেলসহ অনেক কিছুই চুরি হয়েছে ও বেশ কিছু ধরাও পড়েছে আর সেই রিলিফ পণ্যের বিক্রিত অর্থকে বৈধতা দিতেই কি এই সুব্যবস্থা! যেহেতু, যে শ্রেণির লোকেরা রিলিফের পণ্য বিক্রি করেছে তাদের শিল্প কলকারখানা স্থাপনের অভিজ্ঞতা নেই বলেই কি তাদের অপ্রদর্শিত অর্থ সরাসরি ব্যাংক ও সঞ্চয় স্কিমে রাখার ব্যবস্থা করে দিয়ে তাদেরকে সুযোগ দেয়া হলো? কালো রংয়ের আসলে কোনো টাকা নেই। চুরি, ঘুষ, লুট, কালোবাজারি, বাটপারিসহ অনৈতিক পথে হাসিল করা টাকার অফিশিয়াল নাম কালো টাকা। অর্থনীতিবিদরা একে ডাকেন অপ্রদর্শিত আয় নামে। আমজনতা সরল বাংলায় বলে ‘হারাম কামাই’। মজার ব্যাপার হলো, দেশে এই অপ্রদর্শিত আয়ের অংকের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। পুরোটাই ধারনানির্ভর। সাদাকালো হরফের নবাজেটে আবার বলা হয়েছে, কেউ তার কাছে হারামের টাকা বা কালো টাকা আছে বলে স্বীকার করলে তার কাঁধে কোন বালা-মুসিবত চাপবে না। মাত্র দশ পার্সেন্ট ট্যাক্স দিলেই সব হারাম টাকা হালাল হয়ে যাবে। এরপর এ টাকা যে কোন কাজে ব্যবহার বা বিনিয়োগ করা যাবে। অথচ, আইনে আছে চুরির টাকা খুঁজে বের করে সরকারি কোষাগারে জমা করতে হবে। শাস্তি দিতে হবে কালো টাকাওয়ালাদের। কিন্তু, হলোটা কী? বিচারের বদলে তাদেরকে প্যাকেজ অফার করতে হয়! কি চমৎকার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা তাদের সম্মানে? এদিকে পাচার করা টাকা দেশে আনা হবে বা আসবে-এমন নিশ্চয়তাও নেই। কালো টাকা বাজেয়াপ্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেমন প্রভাব ফেলত তেমনি লুটপাট ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে নৈতিক অবস্থান তৈরি সৃষ্টি করত। কিন্তু পুরনো ফরমেটে তৈরি নতুন বাজেটের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা গেল না। বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করা যে সম্ভব নয়, বাজেট তা আবার প্রমাণ করল। আগে দেখা যেত সরকার অপ্রদর্শিত অর্থ শিল্প কলকারখানা স্থাপনে, পুঁজিবাজারে বা দেশের যেকোনো উন্নয়নমূলক কাজে বিনিয়োগের জন্য সুযোগ করে দিত যা প্রশ্নাতীত ছিল। কিন্তু, এবার এক একজনের ব্যক্তিস্বার্থে সঞ্চয় পত্রে বা এফডিআরে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেয়ার প্রস্তাব এসেছে যা একটা উন্নয়নশীল রাস্ট্রে কখনো কাম্য নয়। একবার ব্যক্তিগত সুবিধার্থে, যেমন সঞ্চয় পত্র বা এফডিআর এ বিনিয়োগের সুযোগ পেলে প্রতি বছর এই সুবিধাভোগী শ্রেণী কর ফাঁকি দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থের পাহাড় গড়ে তুলতে উৎসাহিত হবে।
বাজেটে এসএমই খাত,আর পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা কী পেলো? সংশ্লিষ্টরা বলছেন এ খাতে প্রাপ্তি অশ্বডিম্ব। সুয়োরানী-দুয়োরানীর কিচ্ছার অবস্থা। দুয়োরাণীর দিকে রাজার দৃষ্টি পড়ার কথা নয়। গুনে গুনে ছয়টি সুবিধা আদায় করেছে গার্মেন্টস ওয়ালা- তথা সরকারের সুয়োরানী। অবশ্য তা সম্ভব হয়েছে, শ্রমিকদের চাকরি জিম্মি করে। এতেও গার্মেন্ট শ্রমিকদের চাকরিটা অন্তত বজায় থাকলে একটা কথা ছিল। আর এক দুয়োরাণী-দেশের কৃষিতে নতুন কোন ঘোষনা আসেনি। আগের করা অঙ্গীকারগুলিই পড়ে শোনানো হয়েছে কেবল। এইটাই স্বাভাবিক।সংখ্যায় বেশী হলেও -অসংগঠিত হওয়ায়, কৃষকদের কেউ জমা খরচ দেয় না। কৃষকরা ফসল ওঠার পর কেবল সংরক্ষনের সুবিধার অভাবে-কমদামে তা বেচে দিতে বাধ্য হয়। আর আর্থিক ক্ষমতাবান বড় শিল্পগ্রুপ গুলো পানির দামে ব্যাংকের টাকায় সেই ফসল কিনে নেয়।
বছর দশেক আগেও অবস্থাটা এমন ছিল না। বাজেট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উত্তেজনার যে অবশিষ্ট ছিল এখন তার ছিঁটাফোটাও নেই। এটা এখন কিছু নির্দিষ্ট মাথাওয়ালাদের বিষয় হয়ে গেছে। এর নেপথ্য ট্র্যাজেডি হচ্ছে,বাজেট বিষয়ে বর্তমান সংসদের সরকারি দল আর বিরোধীদলের মন-মনন কাছাকাছিই। প্রায় অভিন্ন কৌশল তাদের। বিরোধীদল ধরেই নেয়, সরকার তাদের কেয়ার করে না। তাদের মতামত নেওয়ার নূন্যতম গরজ বোধ করে না। আসল কথা হচ্ছে বাজেট প্রনয়ণ ও পাস দু’টাই একটি বিজনেস কমিউনিটির আয়ত্বে। তারাই সরকার। তারাই ব্যাবসায়ী। জনগন সেটাকে ললাটের লিখন বলে মেনে নিতে বাধ্য এবং অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাদের মূল আগ্রহ থাকে বাজেটে তাদের জীবন বাঁচানো আর জীবিকা রক্ষার কোনো সুরাহা হবে কি না। গত অর্থবছরের তুলনায় এবার ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বাজেট ঘোষিত হলেও সে অনুযায়ী কৃষি, স্বাস্থ্য, জন-সুরক্ষা, শিক্ষা, গবেষণা, কর্মসংস্থান খাতে তেমন উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ বাড়েনি। দেশের এবং বিশ্ব অর্থনীতির বাস্তবতাকে বিবেচনায় না নিয়ে প্রবৃদ্ধি বেশি দেখানোর প্রবণতা বাজেটের বাস্তবায়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দেশে উচ্চবিত্ত ও নব্যধনী মানুষের উত্থান আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। তারা বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন বেশি, পানিও তারা বেশি ব্যবহার করেন, রাস্তাঘাটে তারাই গাড়ি চালান, অর্থাৎ জনগণের করের টাকায় এবং শ্রমে যা কিছু উৎপাদিত হয় তার বেশি ব্যবহারের সুবিধা তারাই পান।
পুঁথিগতভাবে বাজেটের ফিসক্যাল পলিসি ক্লাস নাইন-টেনের অর্থনীতির শিক্ষার্থীরাও জানে। কিন্তু, বাস্তবে বাজেট কেবল সরকারের আয়- ব্যয়ের হিসাব নয়। এটি ধারণকৃত ফিসক্যাল পলিসির বিপরীতে ক্ষমতায় থাকা দলটির রাজনৈতিক আদর্শের প্রতিফলন। আর নিষ্ঠুর সত্য হচ্ছে, স্বাধীনতার পর প্রথম কয়েক বছর বাদ দিলে- বিগত ৪৫ বছরের কোনো ক্ষমতাসীন দলেরই সত্যিকারের রাজনৈতিক আদর্শ ছিল না। সবার একই আদর্শ ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতা ধরে রাখা। এতে কেউ বেশি সফল। কেউ কম। ক্ষমতার উদ্দেশ্য সাধনে তারা নিজেদের সুবিধা মতো এডহক বাজেট কার্যকর করে আসছেন। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। বরাবরের মতো এ বাজেট বিশ্লেষণেও দেখা যায় ব্যাপক অংকের রাজস্ব আদায়ের টার্গেট। আর সরকারের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতার বাইরের রাজস্ব আর উন্নয়ন ব্যয়ের নামে-সেই টাকার সিংহভাগ অপচয়। দুর্নীতি-পাচারের সুযোগও পরতে পরতে। আর বেশি না বুঝে আরেক মহলের সোজা বুঝ হচ্ছে, বাজেট মানে মানুষের উপর করের বোঝা। দেশের উপর ঋণের বোঝা চাপিয়ে বছর বছর রাজপুন্যাহ।তাই বাজেট বড় হলে ভয়ও বাড়ে। সত্যজিত রায়ের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘ভর পেট নাহি খাই, রাজ কর দেয়া চাই’-এর মতো দশা মানুষের।
স্বাস্থ্যে বাজেট বাড়ার সুখবর দুঃসংবাদে পরিণত হতে বিলম্ব হয়নি। আবার স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটার মহাদুর্নীতির নতুন নতুন চিত্রও বেরিয়ে আসছে। প্রকাশ্য বিষয়ে যে মিথ্যাচার এ মন্ত্রণালয় কোভিড নিয়ে করেছে তাতে জনগণের আশংকা এই চক্র সামনে আরো বেপরোয়া ও লাগামহীন হবে। বিড়াল না সরিয়ে রান্নাঘরে মাছের সরবরাহ বাড়িয়ে সেই পথই করা হয়েছে। কারোই জানার বাকি নেই যে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বাড়তি কামাইয়ের জায়গা। এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর চাঁদ কপাল। করোনার পরে দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল,স্বাস্থসেবা খাতে বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ অনেক বাড়ানো হবে।আশানুরূপ না বাড়লেও আগের বছরের চেয়ে প্রায় ২০% বেড়েছে। এছাড়া কোভিড-১৯ এর জন্য জরুরি প্রয়োজন মেটাতে দশ হাজার কোটি টাকার একটা জরুরী ফান্ড রাখা হয়েছে। সমস্যা আসলে অন্য জায়গায়। সেই সমস্যা হলো-স্বাস্থ্যসেবা খাতে অপচয় দুর্নীতি।
হাসপাতালগুলোতে আগের সরঞ্জাম খরিদের দুর্নীতির বিষয় শেষ না হতেই এলো পিপিই,মাস্কসহ সরঞ্জাম খরিদে অনিয়ম আর দুর্নীতির খবর। সেইটার রেশ কাটতে না কাটতেই,দেশের মানুষ অবাক হয়ে জানলো স্বাস্থ্যসেবার জন্য ডাটাবেজ তৈরিতে পুকুর চুরির খবর। তারা বুঝতে অক্ষম এই করোনা কালে মানুষ যেখানে চিকিৎসা না পেয়ে দিশেহারা, সেখানে এই বিভাগের লোকজন একের পর এক এহেন অপকর্ম কিভাবে করে যেতে পারছে? স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ পাঁচগুণ বাড়ানো হলেই বা কী। কার লাভ? জনগণের নয়। লাভ হল লুটেরা ঠিকেদার, দুর্নীতিবাজ কিছু রাজনীতিক, আমলা আর স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজনের। ডাক্তারদের বেতন বাড়িয়ে মাসে দু লাখ টাকা করলেও কেউ গ্রাম তো দূরের কথা উপজেলায়ও যাবে না। কিছু অসাধু ডাক্তার সরকারি চাকরি করে রোগী বাগানোর জন্য। এজন্য মাইনে করা দালাল আছে। আবার ধরা যাক, শিক্ষাখাতে বররাদ্দ বাজেটের ৪০ ভাগ করা হল। কী হবে? শিক্ষকরা নিজেদের পেশাগত মানোন্নয়নে সচেষ্ট হবেন না। তারা কাজে ফাঁকি দেবেন, কোচিং করবেন। স্বাস্থ্যসহ যে কোনো খাতেই বরাদ্দ বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে লুটপাট, দুর্নীতি, অপচয় বাড়ে। জনগণের পকেট কাটা যায় আরও বেশি করে। সুশাসন, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা না থাকায় বাজেট আপনাআপনিই লুটপাটের আইনি দলিল হয়ে যায়। আসল সমস্যা হচ্ছে নৈতিকতার প্রবল সংকট।
এবারের বাজেটে আগের বছরের প্রকৃত আদায়ের চেয়ে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৫০% বাড়ানো হয়েছে,যা জনগনের কাছ থেকেই আদায় করা হবে। এই করের মধ্যে বেশীরভাগ আবার পরোক্ষ কর যা, আমজনতাই দিয়ে থাকে। অন্যদিকে, অপ্রদর্শিত অর্থ ব্যাংকে নগদে, এফডিআর’এ, বিভিন্ন সঞয়ী স্কিমে ১০% কর পরিশোধে বিনিয়োগের সুযোগের প্রস্তাব রাখা হয়েছে! এর আগে কখনো এমন প্রস্তাব করা হয়নি। একটা ছোট প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে। তা হলো- এবছর রিলিফের চাল, তেলসহ অনেক কিছুই চুরি হয়েছে ও বেশ কিছু ধরাও পড়েছে আর সেই রিলিফ পণ্যের বিক্রিত অর্থকে বৈধতা দিতেই কি এই সুব্যবস্থা! যেহেতু, যে শ্রেণির লোকেরা রিলিফের পণ্য বিক্রি করেছে তাদের শিল্প কলকারখানা স্থাপনের অভিজ্ঞতা নেই বলেই কি তাদের অপ্রদর্শিত অর্থ সরাসরি ব্যাংক ও সঞ্চয় স্কিমে রাখার ব্যবস্থা করে দিয়ে তাদেরকে সুযোগ দেয়া হলো? কালো রংয়ের আসলে কোনো টাকা নেই। চুরি, ঘুষ, লুট, কালোবাজারি, বাটপারিসহ অনৈতিক পথে হাসিল করা টাকার অফিশিয়াল নাম কালো টাকা। অর্থনীতিবিদরা একে ডাকেন অপ্রদর্শিত আয় নামে। আমজনতা সরল বাংলায় বলে ‘হারাম কামাই’। মজার ব্যাপার হলো, দেশে এই অপ্রদর্শিত আয়ের অংকের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। পুরোটাই ধারনানির্ভর। সাদাকালো হরফের নবাজেটে আবার বলা হয়েছে, কেউ তার কাছে হারামের টাকা বা কালো টাকা আছে বলে স্বীকার করলে তার কাঁধে কোন বালা-মুসিবত চাপবে না। মাত্র দশ পার্সেন্ট ট্যাক্স দিলেই সব হারাম টাকা হালাল হয়ে যাবে। এরপর এ টাকা যে কোন কাজে ব্যবহার বা বিনিয়োগ করা যাবে। অথচ, আইনে আছে চুরির টাকা খুঁজে বের করে সরকারি কোষাগারে জমা করতে হবে। শাস্তি দিতে হবে কালো টাকাওয়ালাদের। কিন্তু, হলোটা কী? বিচারের বদলে তাদেরকে প্যাকেজ অফার করতে হয়! কি চমৎকার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা তাদের সম্মানে? এদিকে পাচার করা টাকা দেশে আনা হবে বা আসবে-এমন নিশ্চয়তাও নেই। কালো টাকা বাজেয়াপ্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেমন প্রভাব ফেলত তেমনি লুটপাট ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে নৈতিক অবস্থান তৈরি সৃষ্টি করত। কিন্তু পুরনো ফরমেটে তৈরি নতুন বাজেটের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা গেল না। বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করা যে সম্ভব নয়, বাজেট তা আবার প্রমাণ করল। আগে দেখা যেত সরকার অপ্রদর্শিত অর্থ শিল্প কলকারখানা স্থাপনে, পুঁজিবাজারে বা দেশের যেকোনো উন্নয়নমূলক কাজে বিনিয়োগের জন্য সুযোগ করে দিত যা প্রশ্নাতীত ছিল। কিন্তু, এবার এক একজনের ব্যক্তিস্বার্থে সঞ্চয় পত্রে বা এফডিআরে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেয়ার প্রস্তাব এসেছে যা একটা উন্নয়নশীল রাস্ট্রে কখনো কাম্য নয়। একবার ব্যক্তিগত সুবিধার্থে, যেমন সঞ্চয় পত্র বা এফডিআর এ বিনিয়োগের সুযোগ পেলে প্রতি বছর এই সুবিধাভোগী শ্রেণী কর ফাঁকি দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থের পাহাড় গড়ে তুলতে উৎসাহিত হবে।
বাজেটে এসএমই খাত,আর পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা কী পেলো? সংশ্লিষ্টরা বলছেন এ খাতে প্রাপ্তি অশ্বডিম্ব। সুয়োরানী-দুয়োরানীর কিচ্ছার অবস্থা। দুয়োরাণীর দিকে রাজার দৃষ্টি পড়ার কথা নয়। গুনে গুনে ছয়টি সুবিধা আদায় করেছে গার্মেন্টস ওয়ালা- তথা সরকারের সুয়োরানী। অবশ্য তা সম্ভব হয়েছে, শ্রমিকদের চাকরি জিম্মি করে। এতেও গার্মেন্ট শ্রমিকদের চাকরিটা অন্তত বজায় থাকলে একটা কথা ছিল। আর এক দুয়োরাণী-দেশের কৃষিতে নতুন কোন ঘোষনা আসেনি। আগের করা অঙ্গীকারগুলিই পড়ে শোনানো হয়েছে কেবল। এইটাই স্বাভাবিক।সংখ্যায় বেশী হলেও -অসংগঠিত হওয়ায়, কৃষকদের কেউ জমা খরচ দেয় না। কৃষকরা ফসল ওঠার পর কেবল সংরক্ষনের সুবিধার অভাবে-কমদামে তা বেচে দিতে বাধ্য হয়। আর আর্থিক ক্ষমতাবান বড় শিল্পগ্রুপ গুলো পানির দামে ব্যাংকের টাকায় সেই ফসল কিনে নেয়।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।