মহামারীতে দেশ এখন রাজনীতিহীন। কিন্তু, করোনা নিয়ে রাজনীতিপনার কমতি নেই। একেকদিন একেক কথা। একেক সিদ্ধান্ত আরোপ। নিজে এক মাস আইসোলেশনে থেকে বেরিয়ে এসে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক নিয়মিত স্বাস্থ্য পর্যালোচনার এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর নানা বন্দনা করে জানিয়ে বসলেন, আগামী-দুতিন বছরেও করোনা যাবে না। এ নিয়ে তোলপাড় চারদিকে, অবশেষে ধাতানি খেয়ে পরদিন বক্তব্য প্রত্যাহার করে দুঃখপ্রকাশ করলেন। রীতিমতো সার্কাস। এরমাঝেই লকডাউন নিয়ে লাল-নীল, সবুজের লুডু খেলা। এসব করতে করতে সর্বনাশের ষোলোকলাও শেষ । করোনায় মৃত্যুর মিছিল কেবল দীর্ঘ হচ্ছে। আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে দিন দিন।
দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ভঙ্গুর দশা এই মহামারীতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্পষ্ট হয়েছে। কত মানুষ যে করোনার উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসা না পেয়ে,হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে মৃত্যুবরণ করেছে তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। দেশে সরকারি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স নেই, হাসপাতালে নেই আইসিইউ বেড। নেই ভেন্টিলেটর আর অক্সিজেনের সুব্যবস্থা। বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে মানুষ। তিন-চারদিন ধরে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে করোনা পরীক্ষা করবার জন্য চেষ্টা করছে তারা। তিন মাস পরেও আক্রান্ত অনুপাতে করোনা শনাক্তকরণের পর্যাপ্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যায়নি। তবে, গণস্বাস্থ্য উদ্ভাবিত কিট অনুমোদন না দেবার ব্যবস্থা ঠিক মতোই করেছে। অথচ এত বড় বিপর্যয়ের মধ্যেও লুটপাট-দুর্নীতি থামেনি। তারওপর তামাশার মতো লাল, নীল জোন ভাগ করে আরেকটি নাটকের অবতারণা। খারাপ সময় এতো গড়ালেও চৈতন্য আসার নমুনা নেই আমাদের। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে প্রথম চীনে করোনার সংক্রমণ দেখা দেয়ার পর তিন মাস সময় পাওয়ার পরও বিমান, নৌ এবং স্থল বন্দরগুলোতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া রোখার কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে লকডাউনের পরিবর্তে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে ঢাকা থেকে মানুষকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার তাদেরকে উড়া খবরে ঢাকায় ডেকে এনেছে। এরমধ্য দিয়ে করোনার বিস্তারে অতিমাত্রা যোগ হয়েছে। কিছুদিন আবার প্রবাসীদের ‘করোনা ভিলেন’ বানানোর অসুস্থ্য প্রচার হয়েছে। প্রবাসীদের রীতিমতো দুশমনের জায়গায় নিয়ে ঠেকানো হচ্ছে। লাল পতাকা টানিয়ে প্রবাসীদের বাড়ি চিহ্নিত করা,পিটুনি দেয়া একরকম আপদের ওপর বিপদ ডেকে আনছে।
আনুষ্ঠানিক কার্যকর না হলেও কার্যত সারাদেশ মানবিকভাবে লকডাউনেই। যে যার মতো করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। সময় পার করতে গিয়ে কেউ কেউ সিনেমা, টিভি, নেট ফ্লিকসে মজে থাকছে। অফিসের কাজে ওয়ার্ক ফ্রম হোমে থেকেই দিনগুজরান করছে অনেকে। হারিয়ে যাওয়া লুডো আবার ফিরে এল করোনার মহিমাতে। একসময় এই লাল, নীল, সবুজ, হলুদ ঘুঁটির কাটাকাটির খেলা ছিল বেশ জনপ্রিয়। তবে নয়ের দশকের প্রারম্ভে প্রায় একেবারেই বিদায় নিয়েছিল এই খেলা। বিদায় নেওয়ার মূল কারণ তখন নতুন প্রজন্মের কাছে চলে এসেছে ভিডিও গেমের কি-বোর্ড এবং নিত্যনতুন অসংখ্য গেম। খেলায়-হেলায় কিছু সময় পার করা যায় সত্য। কাজসিদ্ধ হয় না।
সাধারন ছুটি, লাল সবুজের ছক, লকডাউন, একই সাথে অফিস ব্যাংক বাজার হাট দোকানপাট খোলা, রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম- সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। কথায় আছে ‘সময় গেলে সাধন হবে না’- আমরা সময় হারিয়ে এসেছি। এখন এই লাল নীল রঙের খেলায় খুব একটা কাজ হবে- এমনটা আশা করা বোকামি। মানুষকে একবার ঘরে ঢোকানো হয়েছে। আবার ঘর থেকে বের করে আনা হয়েছে। এখন আবার তাকে ঘরে তোলা কি খুব সহজ হবে ?
গত ঈদের পরপর সুযোগটা তৈরি হয়েছিল। তখন প্রায় এক সপ্তাহের ছুটিতে সবাই পরিবারের সাথে মিলিত হয়েছিল। সেই সুযোগটা নেয়া হয়নি। উপরন্তু, অভয় দেয়া হয়েছে। নিজেদেরকে করোনার চেয়েও শক্তিশালী দাবি করা, করোনার গুজব না ছড়ানোর ধমকি দিয়ে হেয়ালি করা হয়েছে। দেশের প্রায় সকল স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট মহল, সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী একবাক্যে সপ্তাহ দু’য়েকের জন্য কিছু কঠিন পদক্ষেপের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তাতে কোন পাত্তা দেয়া হয়নি। পরিনতিতে যা অনিবার্য ছিল তাই হয়ে চলেছে।
করোনার হানা বর্তমানে কোন স্টেজে আছে, কেউ বলতে পারছেন না।করোনার গতি-চরিত্রও এখন পর্যন্ত অজানা। সবই ধারনানির্ভর। কেউ আন্দাজ করতে পারছেন না কোন পর্যন্ত গিয়ে ঠেকবে। কোন কোন স্টাডি ভয় দেখাচ্ছে ঢাকা শহরে বসবাসকারি ষাট থেকে সত্তুর পার্সেন্ট মানুষ আক্রান্ত হবে। যদি হয় তাহলে কি অবস্থা হবে ভাবাই যায় না।
এ দিকে দেশে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাউকে কখনও জাবাবদিহি করতে হয় না। বোধবুদ্ধিমানরা ভালো করেই জানেন, দুর্নীতির যাবতীয় আয়োজন বা বীজ আমাদের রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার মধ্যেই লুকানো। দুর্নীতির অপার সুযোগ এখন সমাজব্যবস্থার রন্দ্রে রন্দ্রে। চালাক-চতুররা সেই সুযোগটার ষোলোআনা ব্যবহার করছেন। এগিয়ে থাকার প্রতিযোগিতার সঙ্গে যুথবদ্ধও তারা। প্রতিজ্ঞাবদ্ধের মতো মহামারির সুযোগের একটুও হাতছাড়া করছেন না তারা।
এতো কিছুর পরও ধারনা করা হয়েছিল এই মহামারি মানুষের মধ্যে কিছুটা হলেও মনুষ্যত্ব জাগাবে। সর্বগ্রাসী করোনা মানুষকে একটু- আধটু হলেও ভেদাভেদ ভোলাবে, দুর্নীতি- অপকর্মমুক্ত করে মানবিক হবার তাগিদ দেবে। কিন্তু, বাস্তব বড় কঠিন। নিদারুণ। চারদিকে উল্টা ইঙ্গিত। মহামারী বরং অনেককে আরো বেপরোয়া করছে। মওকা করে দিচ্ছে কোটি-কোটি টাকা হাতানোর। চুরি, দুর্নীতিসহ অনৈতিক নানা ঘটনা বিবেকবানদের দগ্ধ করছে। এমন নাহালত বা আজাবের মধ্যেও কি করে এগুলো সম্ভব হচ্ছে? প্রশ্ন কুলকিনারাহীন হলেও জবাব নেই। জবাব না পেলেও অবিচার-অনাচার, দুর্নীতি যে কারো কারো মজ্জাগত হয়ে গেছে-সেটা পরিস্কার হয়ে গেছে এই ভয়াল করোনা মহামারির মধ্যেও।
একদিকে, আশঙ্কাজনক হারে করোনার বিস্তার ঘটছে। আরেকদিকে, দুর্নীতি-চুরি-চামারিতে টাকা হাতানোর প্রতিযোগিতা। প্রণোদনা হাসিলের চাতুরি। ভাইরাসের চাষাবাদ করে অসহায় মানুষের জীবন নিয়ে তামাশা। লকডাউন শুরুর পর থেকে হাজার-হাজার শ্রমিককে ছাঁটাই। রুজি-রোজগার বন্ধ হওয়ায় পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন তাদের। করোনা ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি, লুণ্ঠনের লাগাম টানতে পারেনি। দমাতে পারেনি ব্যাংক ডাকাতদের। করোনা মহামারিতে মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে আসা আম্পান দুর্যোগকে ছাপিয়ে অর্থনীতির ক্ষেত্রে ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় চারদিকেই। এই করোনাকালেই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপি কমিশনারকে ডিএমপিরই এক যুগ্ম কমিশনারের সরাসরি দেওয়া ঘুষের প্রস্তাবে তোলপাড় পুলিশের শীর্ষ মহলে। এমন অনৈতিক প্রস্তাবে কমিশনার চরম ক্ষুব্ধ ও বিব্রত। যুগ্ম কমিশনার (লজিস্টিকস) এর ঘুষের প্রস্তাবের বিষয়টি তিনি গোপন রাখেননি। পরিণামে অভিযুক্তকে বদলি করা হয়েছে। প্রায় একই কাণ্ড স্বাস্থ্যসচিবের ক্ষেত্রে। দেশের স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ একেবারেই নতুন নয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন কার্যালয়ে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে দুর্নীতির শক্তিশালী বলয় তৈরি হয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ওষুধ, সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে সিন্ডিকেট গঠন করে স্বাস্থ্য খাতে জনসাধারণের জন্য বরাদ্দ সরকারি বাজেটের একটি বড় অংশ হাতিয়ে নিচ্ছে। এ রকম সময়ে দুর্নীতি বিষয়ে বার্তা নিয়ে এসেছেন দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক চেয়ারম্যান। বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে দুর্নীতিবাজদের প্রতি নমনীয় হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ক্যাসিনোকাণ্ডে কমিশনের অনুসন্ধান বা তদন্তে শিথিলিতা এসেছে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের চেয়ারম্যান বলেছেন, গণমাধ্যমে এ জাতীয় সংবাদ দেখেছি। তবে আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে পারি, কমিশন ক্যাসিনোকাণ্ডে যে সব অভিযোগ আমলে নিয়েছে সেসব বিষয়ে অনুসন্ধান বা তদন্তে শিথিলতার কোনো সুযোগ নেই। করোনার কারণে অপরাধীদের প্রতি ন্যূনতম নমনীয় হওয়ারও সুযোগ নেই। প্রতিটি অনুসন্ধান ও তদন্ত চলমান রয়েছে। এন-৯৫ মাস্ক ও পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) কেনায় দুর্নীতি হয়েছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, করোনা মহামারী শুরুর প্রারম্ভেই এসব সামগ্রী ক্রয় প্রক্রিয়া শুরু হয়। যে কোনো প্রয়োজনে যে কোনো প্রতিষ্ঠান ক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা করবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু, এক্ষেত্রে আসলে দুদকের করণীয় কিছু কি আছে?
দুদক চেয়ারম্যানের বক্তব্য শুনতে সুন্দর। তিনি দুর্নীতি দমনে যে প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন এগুলো খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আর সেটা জেনেবুঝেই বিভিন্ন সেক্টরের চতুরেরা এমন মহাদুর্যোগ সময়েও পুকুর চুরির বদলে সাগর চুরিতে নেমেছে কোমর বেঁধে।
লেখকঃসাংবাদিক ও কলামিস্ট।
rintu108@gmail.com